‘অর্পিত সম্পত্তি’ ও বাংলাদেশের ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’
শত্রু সম্পত্তি কী বা কাকে বলে?
শত্রু সম্পত্তি বা Enemy Property ‘র প্রাথমিক ধারণাটি হলো এগুলো সেই সম্পত্তি যা এমন ব্যক্তিদের ছিল যারা ভারতের স্বাধীনতার পর পাকিস্তান বা চীনে চলে গেছে এবং সেই দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর, ভারত সরকার Enemy Property Act, 1968 প্রণয়ন করে এবং এই সম্পত্তিগুলো সরকারী নজরদারিতে নেওয়া হয়। সরকার এই সম্পত্তিগুলো সংরক্ষণ এবং পরিচালনার জন্য একজন Custodian নিয়োগ করে।
এই আইন অনুযায়ী, শত্রু সম্পত্তি ভারতের সরকারের সম্পত্তি বলে বিবেচিত হয় এবং এর মালিকানা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দাবি করতে পারে না, যদিও সেই ব্যক্তিরা ভারতে বসবাস করত বা তাদের উত্তরাধিকারীরা ভারতীয় নাগরিক।
“শত্রু সম্পত্তি” শব্দটি ভারত এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিতর্কিত বিষয়। দুই দেশের স্বাধীনতার সময় থেকে এই সম্পত্তির উপর নানা ধরনের আইনি ও সামাজিক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এই ব্লগে, আমরা শত্রু সম্পত্তির ইতিহাস, বিদ্যমান আইন, প্রাসঙ্গিক তথ্য, পুনর্বাসন প্রক্রিয়া এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
শত্রু সম্পত্তির ইতিহাস
ভারত
ভারতে শত্রু সম্পত্তি মূলত ১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান বিভক্তি এবং পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তৈরি হয়েছিল। বিভক্তির সময় অনেক মুসলিম পরিবার পাকিস্তানে চলে যায় এবং তাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয়। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়, এই সম্পত্তিগুলির উপর আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
বাংলাদেশ
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শত্রু সম্পত্তির ইতিহাস পাকিস্তানের শাসনামলে ফিরে যায়। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় অনেক হিন্দু পরিবার ভারত চলে যায় এবং তাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, এই সম্পত্তিগুলি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে পরিচিত হয়।
বিদ্যমান আইন
ভারত
- ১৯৬৮ সালের শত্রু সম্পত্তি আইন: এই আইনটি প্রণয়ন করা হয় পাকিস্তানে চলে যাওয়া ব্যক্তিদের রেখে যাওয়া সম্পত্তির উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে। এই আইন অনুযায়ী, শত্রু সম্পত্তি আইনত রাষ্ট্রের অধীনে আসে এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
- ২০১৬ সালের সংশোধনী: এই সংশোধনী শত্রু সম্পত্তির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইনকে আরও কঠোর করে। এই আইন অনুযায়ী, শত্রু সম্পত্তি কোনভাবেই উত্তরাধিকারীদের কাছে ফিরে আসতে পারবে না।
বাংলাদেশ
- ১৯৬৫ সালের শত্রু সম্পত্তি (অধিগ্রহণ) আইন: পাকিস্তান সরকার এই আইনের মাধ্যমে শত্রু সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে।
- ১৯৭৪ সালের অর্পিত সম্পত্তি আইন: বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, এই আইনটি প্রণয়ন করা হয় এবং শত্রু সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
ভারতের শত্রু সম্পত্তি (সংশোধন ও বৈধতা) আইন, ২০১৭
মোদি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজু শত্রু সম্পত্তি (সংশোধনী ও বৈধতা) বিল, ২০১৬ উত্থাপন করেন। এই সংশোধনী ৭ জানুয়ারী ২০১৬ এ জারি করা একটি অধ্যাদেশ প্রতিস্থাপন করার উদ্দেশ্যে উত্থাপিত হয়েছিল।
২০১৬-এর বিলের ধারাগুলো নিম্নরূপ:
- বিলটি শত্রু সম্পত্তি আইন, ১৯৬৮ সংশোধন করেছে, যাতে শত্রু সম্পত্তির উপর সমস্ত অধিকার, শিরোনাম এবং স্বার্থ ভারতের জন্য শত্রু সম্পত্তির রক্ষকের হাতে ন্যস্ত করা হয়।
- বিলটি আইনের অধীনে পরিচালিত শত্রু দ্বারা শত্রু সম্পত্তি হস্তান্তরকে বাতিল বলে ঘোষণা করে। এটি ১৯৬৮ সালের আগে বা পরে সংঘটিত স্থানান্তরের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তীভাবে প্রযোজ্য।
- বিলটি দেওয়ানি আদালত এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে শত্রু সম্পত্তি সম্পর্কিত বিরোধগুলো উপভোগ করতে নিষেধ করে।
বিলটি ১০ মার্চ ২০১৭ তারিখে রাজ্যসভায় পাস হয়েছিল। বিলটি রাজ্যসভায় সংশোধনী সহ, ১৪ মার্চ ২০১৭-এ লোকসভা দ্বারা পাস হয়।
তথ্যঃ উইকিপিডিয়া
প্রাসঙ্গিক তথ্য
১. শত্রু সম্পত্তির পরিমাণ: দুই দেশেই শত্রু সম্পত্তির পরিমাণ বিশাল। ভারতে লক্ষ লক্ষ একর জমি এবং হাজার হাজার বাড়ি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে রয়ে গেছে।
২. আইনি বিতর্ক: শত্রু সম্পত্তি নিয়ে দুই দেশেই অসংখ্য মামলা হয়েছে। অনেক সময়, এই সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী আইনি লড়াই হয়েছে, যা এখনও চলমান।
পুনর্বাসন
ভারত
ভারতে শত্রু সম্পত্তি পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরকার বিভিন্ন সময়ে শত্রু সম্পত্তির নিলাম করেছে এবং এই সম্পত্তির বিক্রয় থেকে প্রাপ্ত অর্থ সরকারি তহবিলে জমা হয়েছে। এছাড়া, শত্রু সম্পত্তি পুনর্বাসনের জন্য বিশেষ কমিশন গঠন করা হয়েছে, যা সম্পত্তি পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন নীতি ও নির্দেশনা প্রণয়ন করে।
বাংলাদেশ
বাংলাদেশেও অর্পিত সম্পত্তির পুনর্বাসনের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ২০০১ সালে “অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন” প্রণয়ন করা হয়, যার মাধ্যমে পূর্বের মালিক বা তাদের উত্তরাধিকারীরা এই সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করতে পারে। তবে, এই প্রক্রিয়া প্রায়ই জটিল ও সময়সাপেক্ষ হয়ে থাকে এবং প্রায়ই আইনি জটিলতার সম্মুখীন হয়।
আরও পড়ুন- অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন, ২০১১
বর্তমান প্রেক্ষাপট
বর্তমানে শত্রু সম্পত্তি নিয়ে বিতর্ক ও আইনি জটিলতা দুই দেশেই বিদ্যমান। ভারতে ২০১৬ সালের শত্রু সম্পত্তি আইনের সংশোধনী নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছে এবং অনেকেই এর বিরোধিতা করেছে। বাংলাদেশে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া ধীরগতির কারণে এখনও অনেক সম্পত্তি পুনর্বাসনের অপেক্ষায় রয়েছে।
ভারতে এবং বাংলাদেশে শত্রু সম্পত্তি নিয়ে বর্তমান প্রেক্ষাপট:
ভারত
১. সম্পত্তির নিলাম: ভারত সরকার শত্রু সম্পত্তির নিলামের মাধ্যমে এই সম্পত্তির বিক্রয় করছে এবং এই প্রক্রিয়া চলমান।
২. আইনি চ্যালেঞ্জ: শত্রু সম্পত্তি আইন নিয়ে আইনি চ্যালেঞ্জ এখনও বিদ্যমান এবং অনেক মামলা বিচারাধীন।
বাংলাদেশ
১. প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া: বাংলাদেশে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া ধীরগতিতে চলছে এবং অনেক সম্পত্তি এখনও পুনর্বাসনের অপেক্ষায়।
২. আইনি লড়াই: অর্পিত সম্পত্তি নিয়ে অনেক আইনি লড়াই এখনও চলমান এবং এর সমাধান খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা চলছে।
উপসংহার
শত্রু সম্পত্তি নিয়ে ইতিহাস, বিদ্যমান আইন, প্রাসঙ্গিক তথ্য, পুনর্বাসন এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায় যে এটি একটি জটিল ও বিতর্কিত বিষয়। দুই দেশেই শত্রু সম্পত্তি নিয়ে আইনি ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান এবং এর সমাধান খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা চলছে। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলির যৌথ প্রচেষ্টায় এই সমস্যার সমাধান সম্ভব হতে পারে এবং শত্রু সম্পত্তি পুনর্বাসনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অধিকার নিশ্চিত করা যেতে পারে।
[…] আরও পড়ুন- শত্রু সম্পত্তি ( অর্পিত সম্পত্তি)’র ইত… […]
[…] […]
[…] শত্রু সম্পত্তি ( অর্পিত সম্পত্তি)’র ইত… […]