হিজরি ইসলামিক নববর্ষ ১৪৪৬ এবং আশুরা
ইসলামী ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস হচ্ছে মহররম, আর ১ মহররম দ্বারা শুরু হয় নতুন হিজরি বর্ষ। এই দিনটি ইসলামী ইতিহাসে একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন হিসেবে বিবেচিত হয়। ১ মহররম মুসলিম বিশ্বে বিশেষভাবে উদযাপিত হয় এবং এটি একটি সময় যেখানে মুসলিমরা তাদের মহত্তম ইতিহাসের কাহিনিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে এবং ধর্মীয় বিশ্বাসকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে।
মহররম এর তাৎপর্য
মহররম মাসটি ইসলামী বর্ষপঞ্জির অন্যতম পবিত্র মাস। এটি চারটি পবিত্র মাসের একটি যেখানে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল। এই মাসের বিশেষ তাৎপর্য হচ্ছে, এটি হিজরি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস এবং নতুন বছরের সূচনা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহররম মাসকে ‘শাহরুল্লাহ’ বা আল্লাহর মাস বলছেন। জানা কথা, সকল মাসই আল্লাহর মাস। এরপরও এক মাসকে আল্লাহর মাস বলার রহস্য হলো, এই মাসের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। তাই একে আল্লাহর মাস বলা হয়েছে। যেমন দুনিয়ার সব ঘরই আল্লাহর ঘর। কিন্তু সব ঘরকে বাইতুল্লাহ বলা হয় না। ‘আল্লাহর মাস’ বলে মহররম মাসকে আল্লাহর সাথে সম্বন্ধিত এর মর্যাদা তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া এই হাদিসের মাধ্যমে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহররম মাসে অধিক রোজা রাখার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
রাসুল (সা.) বললেন, ‘রমজানের পর যদি তুমি রোজা রাখতে চাও, তবে মুহররম মাসে রাখ। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তাআলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’
(জামে তিরমিজি, হাদিস : ১/১৫৭)
মহররম মাসের ১০ম দিনটি আশুরা নামে পরিচিত, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বিভিন্ন ইসলামী সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্নভাবে পালিত হয়। এই দিনে ইসলামের ইতিহাসে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে অন্যতম হল হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর কারবালার ময়দানে শহীদ হওয়া।
আশুরা এর তাৎপর্য
আশুরা দিনটি মুসলিমদের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সিয়া মুসলিমদের জন্য, এটি শোক এবং মর্মান্তিক ঘটনার স্মরণে একটি দিন। কারবালার যুদ্ধের সময় ইমাম হুসাইন (রাঃ) এবং তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল, এবং এই দিনটি তাদের ত্যাগের স্মরণে পালিত হয়।
উম্মুল মুমিনিন হজরত হাফসা (রা.) বলেন, রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চারটি কাজ কখনো পরিত্যাগ করেননি। আশুরার রোজা, জিলহজের প্রথম দশকের রোজা, আইয়ামে বিদের রোজা তথা প্রতি মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখের রোজা এবং ফজর ওয়াক্তে ফরজের আগে দুই রাকাত সুন্নাত নামাজ।
আশুরা অর্থ দশম তারিখ। ইসলামি পরিভাষায় মহররমের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। পবিত্র আশুরা ইসলামের অন্যতম ফজিলতপূর্ণ দিন। সৃষ্টির শুরু থেকে ১০ মহররম তথা আশুরার দিনে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা এই দিনে আদম (আ.)–কে সৃষ্টি করেছেন। এই দিনে নুহ (আ.)–এর প্লাবন সমাপ্ত হয়। এদিন ইব্রাহিম (আ.) জালিম বাদশাহ নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে ৪০ দিন পর নিরাপদে মুক্তি পান। এদিন ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পান। এই দিনে আইয়ুব (আ.) রোগমুক্তি লাভ করেন। এই দিনে সুলায়মান (আ.) তাঁর হারানো রাজত্ব ফিরে পান। এই দিনে ইয়াকুব (আ.) হারানো পুত্র ইউসুফ (আ.)–কে ৪০ বছর পর ফিরে পান। এই দিনে ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন এবং এদিনেই তাঁকে দুনিয়া থেকে আকাশে উঠিয়ে নেওয়া হয়। আশুরার দিনে আরও বহু ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল।
পবিত্র আশুরার কাহিনি আমাদের শিক্ষা দেয় আত্মত্যাগের মহিমায় জীবন উৎসর্গ করতে। আশুরা আমাদের অনুপ্রাণিত করে ক্ষমার, মহত্ত্বের আলোকে ইসলামের আদর্শে জীবন গঠণের প্রতি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘মহররম’ কবিতায় সেই আহ্বান শুনি-
“উষ্ণীষ কোরানের, হাতে তেগ্ আরবির,
দুনিয়াতে নত নয় মুস্লিম কারো শির;–
তবে শোনো ঐ শোনো বাজে কোথা দামামা,
শম্শের হাতে নাও, বাঁধো শিরে আমামা!
বেজেছে নাকাড়া, হাঁকে নকিবের তূর্য,
হুশিয়ার ইস্লাম, ডুবে তব সূর্য!
জাগো ওঠো মুস্লিম, হাঁকো হাইদরি হাঁক।
শহীদের দিনে সব-লালে-লাল হয়ে যাক!”
মহররম মাস উদযাপন
মহররম মাস উদযাপন বিভিন্ন মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্নভাবে পালিত হয়, কিন্তু সকলের মধ্যে সাধারণ কিছু প্রথা রয়েছে:
- রোজা রাখা: আশুরা দিনে রোজা রাখা সুন্নি মুসলিমদের মধ্যে একটি সাধারণ প্রথা। এই রোজা পালনের মাধ্যমে তারা অতীতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো স্মরণ করে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করে।
- প্রার্থনা এবং কোরআন পাঠ: মহররম মাসে অধিক প্রার্থনা এবং কোরআন তেলাওয়াত করা হয়। এটি আধ্যাত্মিকতা বৃদ্ধির একটি সময় এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার একটি সুযোগ।
- তাজিয়া মিছিল: সিয়া মুসলিমদের মধ্যে তাজিয়া মিছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারা ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর ত্যাগের স্মরণে মিছিল করে এবং শোক প্রকাশ করে।
- দান-খয়রাত: এই মাসে দান-খয়রাত করা হয়, যা সমাজের দরিদ্র ও অভাবী মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
হজরত হোসাইন (রা.) নিজের জীবন উৎসর্গ করে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন মহররম ও আশুরার প্রকৃত তাৎপর্য। সঙ্গে পরিবারের সদস্যসহ ৭২ জন সঙ্গীর আত্মত্যাগ শিখিয়ে গেল সত্যের প্রতি অবিচল আনুগত্য ও অনুরাগের পরাকাষ্ঠা। শিশু আলী আসগরের শাহাদাত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মহান আল্লাহর বাণী, ‘বলো, ‘‘তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করা অপেক্ষা অধিক প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভ্রাতা, তোমাদের পত্নী, তোমাদের গোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দা পড়ার আশঙ্কা করো আর তোমাদের বাসস্থান, যা তোমরা ভালোবাসো; তবে অপেক্ষা করো আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত।”
উপসংহার
১ মহররম এবং পুরো মহররম মাসটি ইসলামী ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এটি আধ্যাত্মিকতা, প্রার্থনা এবং আত্ম-পর্যালোচনার সময়। মুসলিমদের জন্য, এই মাসটি তাদের ধর্মীয় জীবনকে পুনরুজ্জীবিত করার এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি সুযোগ। মহররমের তাৎপর্য ও ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে ত্যাগ, ধৈর্য এবং বিশ্বাসের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর কাছে আরও ঘনিষ্ঠ হতে পারি।

মহররম ও আশুরার তাৎপর্য এবং কারবালার শিক্ষা https://www.prothomalo.com/opinion/column/lhsuuleszd
Nice content on Islamic New year, ashura and mohorrom. Thank you.