বাংলাদেশের দণ্ডবিধি (Penal Code, 1860) আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য অপরিহার্য একটি আইন। এটি অপরাধের সংজ্ঞা, শাস্তি এবং আইনের নানাবিধ উপাদানকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে। এই ব্লগে আমরা দণ্ডবিধির সকল ধারা এবং তাদের ব্যাখ্যা আলোচনা করবো।

বাংলাদেশ দণ্ডবিধির সারাংশ

প্রথম অধ্যায় (ধারা ১-৫): সাধারণ বিষয়াবলী
এই অধ্যায়ে দণ্ডবিধির শিরোনাম, কার্যকারিতা ও প্রযোজ্য ক্ষেত্র বর্ণিত হয়েছে। দণ্ডবিধি সমগ্র বাংলাদেশে কার্যকর এবং এখানে ব্যবহার করা বিভিন্ন টার্মের সংজ্ঞাও দেওয়া হয়েছে।


দ্বিতীয় অধ্যায় (ধারা ৬-৫২): সাধারণ ব্যাখ্যা

এই অধ্যায়ে বিভিন্ন আইনি টার্মের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। এখানে আইন কীভাবে কাজ করবে এবং আইনের বিশেষ কিছু ব্যতিক্রমের কথা বলা হয়েছে।


তৃতীয় অধ্যায় (ধারা ৫৩-৭৫): শাস্তির প্রকারভেদ

এই অধ্যায়ে বিভিন্ন ধরনের শাস্তির প্রকার ও সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। মূল শাস্তি চার প্রকার:

  • মৃত্যুদণ্ড
  • যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
  • কঠোর কারাদণ্ড
  • অর্থদণ্ড

চতুর্থ অধ্যায় (ধারা ৭৬-১০৬): ক্ষমা ও আত্মরক্ষার অধিকার

এই অধ্যায়ে অপরাধের দায় থেকে অব্যাহতি, আত্মরক্ষার অধিকার এবং আইন প্রয়োগে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের অধিকার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন:

  • ধারা ৯৬: আত্মরক্ষার অধিকার।
  • ধারা ১০০: প্রাণের জন্য বিপজ্জনক আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার অধিকার।

পঞ্চম অধ্যায় (ধারা ১০৭-১২০): অপরাধের প্ররোচনা

এই অধ্যায়ে অপরাধ সংগঠিত করতে কাউকে প্ররোচনা দেওয়া এবং সেজন্য শাস্তির বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারা হলো:

  • ধারা ১০৭: অপরাধে প্ররোচনা।
  • ধারা ১২০: অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র।

ষষ্ঠ অধ্যায় (ধারা ১২১-১৩০): রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ

এই অধ্যায়ে দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, যুদ্ধ ঘোষণা, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রসহ বিভিন্ন অপরাধের কথা বলা হয়েছে। যেমন:

  • ধারা ১২১: রাষ্ট্রদ্রোহ (দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা বা ষড়যন্ত্র)। শাস্তি: মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন।

সপ্তম অধ্যায় (ধারা ১৩১-১৪০): সশস্ত্র বাহিনী সংক্রান্ত অপরাধ

এই অধ্যায়ে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য নির্ধারিত শাস্তি উল্লেখ করা হয়েছে।


অষ্টম অধ্যায় (ধারা ১৪১-১৬০): বেআইনি সমাবেশ ও জনশৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধ

এই অধ্যায়ে বেআইনি সমাবেশ, দাঙ্গা ও জনশৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধ এবং তাদের শাস্তি উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন:

  • ধারা ১৪১: বেআইনি সমাবেশ।
  • ধারা ১৪৬: দাঙ্গা।

নবম অধ্যায় (ধারা ১৬১-১৭১): সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অপরাধ

এই অধ্যায়ে সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি, ঘুষ গ্রহণসহ বিভিন্ন অপরাধ এবং তাদের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে।

  • ধারা ১৬১: ঘুষ গ্রহণ।
  • ধারা ১৬৯: সরকারি কর্মচারীদের জন্য নির্দিষ্ট ব্যবসা বা বাণিজ্যে জড়িত হওয়ার শাস্তি।

দশম অধ্যায় (ধারা ১৭২-১৯০): আদালত ও বিচার সংক্রান্ত অপরাধ

এই অধ্যায়ে আদালতের আদেশ অমান্য করা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া, জালিয়াতি ও বিচার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ সংক্রান্ত অপরাধ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

  • ধারা ১৭৪: আদালতে হাজির না হওয়ার শাস্তি।
  • ধারা ১৯৩: মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।

একাদশ অধ্যায় (ধারা ১৯১-২২৯): নথি জালিয়াতি ও সম্পত্তি সংক্রান্ত অপরাধ

এই অধ্যায়ে দলিল জালিয়াতি, প্রতারণা ও জাল নথি ব্যবহার সংক্রান্ত অপরাধের বিধান দেওয়া হয়েছে। যেমন:

  • ধারা ৪৬৩: জালিয়াতি।
  • ধারা ৪২০: প্রতারণার শাস্তি।

দ্বাদশ অধ্যায় (ধারা ২৩০-২৬৩): মুদ্রা সংক্রান্ত অপরাধ

এই অধ্যায়ে মুদ্রা ও ব্যাংক নোট জাল করার শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে।


ত্রয়োদশ অধ্যায় (ধারা ২৬৪-২৯৪): ভুয়া ওজন, পরিমাপ ও ট্রেডমার্ক সংক্রান্ত অপরাধ

এই অধ্যায়ে ভুয়া পরিমাপ, ওজন বা ট্রেডমার্ক ব্যবহার সংক্রান্ত অপরাধের শাস্তি উল্লেখ করা হয়েছে।


চতুর্দশ অধ্যায় (ধারা ২৯৫-২৯৮): ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সংক্রান্ত অপরাধ

এই অধ্যায়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে এমন কাজের শাস্তি বর্ণিত হয়েছে। যেমন:

  • ধারা ২৯৫: ধর্মীয় স্থান বা প্রতীক ক্ষতিগ্রস্ত করা।

পঞ্চদশ অধ্যায় (ধারা ২৯৯-৩৭৭): ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ

এই অধ্যায়ে খুন, হত্যা, আঘাত, ধর্ষণসহ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধের শাস্তি বর্ণিত হয়েছে। যেমন:

  • ধারা ৩০২: ইচ্ছাকৃত হত্যা।
  • ধারা ৩৭৬: ধর্ষণ।

ষোড়শ অধ্যায় (ধারা ৩৭৮-৪৪০): সম্পত্তির বিরুদ্ধে অপরাধ

এই অধ্যায়ে চুরি, ডাকাতি, প্রতারণাসহ সম্পত্তির বিরুদ্ধে অপরাধের শাস্তি বর্ণিত হয়েছে। যেমন:

  • ধারা ৩৭৯: চুরির শাস্তি।
  • ধারা ৩৯৫: ডাকাতির শাস্তি।

সপ্তদশ অধ্যায় (ধারা ৪৪১-৪৬২): অপরাধমূলক অনুপ্রবেশ

এই অধ্যায়ে বেআইনি প্রবেশ এবং সেই সম্পর্কিত অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন:

  • ধারা ৪৪১: অপরাধমূলক অনুপ্রবেশ।

অষ্টাদশ অধ্যায় (ধারা ৪৬৩-৪৭৭): জালিয়াতি সংক্রান্ত অপরাধ

এই অধ্যায়ে জালিয়াতি ও জাল নথি তৈরি সংক্রান্ত অপরাধ এবং তাদের শাস্তি বর্ণিত হয়েছে।


উনবিংশ অধ্যায় (ধারা ৪৭৮-৪৯৮): বাণিজ্য সংক্রান্ত জালিয়াতি

এই অধ্যায়ে ট্রেডমার্ক বা বাণিজ্য সংক্রান্ত প্রতারণার শাস্তি বর্ণিত হয়েছে।


বিশম অধ্যায় (ধারা ৪৯৯-৫১১): ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্মানহানির অপরাধ

এই অধ্যায়ে মানহানি, ভীতি প্রদর্শন এবং অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত শাস্তি উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন:

  • ধারা ৪৯৯: মানহানি।
  • ধারা ৫০৬: ভীতি প্রদর্শনের শাস্তি।

উপসংহার

বাংলাদেশের দণ্ডবিধি একটি বিস্তৃত আইন যেখানে প্রতিটি ধারা অপরাধের বিস্তারিত ব্যাখ্যা এবং শাস্তি নির্ধারণ করে। আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং বিচারিক পদ্ধতির সুষ্ঠু ব্যবহার সমাজে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।

ভিডিও দেখুন- সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন ১৮৭৭

আরও পড়ুন- সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারা

Icra Iflas Piled Book

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *