ইউনুস এর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এর প্রেক্ষাপট

২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপেক্ষিতে সৃষ্ট অসহযোগ আন্দোলনের ফলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর নতুন সংগঠিত বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন অস্থায়ী সরকার ব্যবস্থা। ড মোহাম্মদ ইউনুস এর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ক এবং সেনাবাহিনী প্রধান দ্বারা নিশ্চিত করা হয়। এবং ৮ আগস্ট শপথ গ্রহণের মাধ্যমে মুহাম্মদ ইউনুসকে অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়।রাষ্ট্রপতি ৬ আগস্ট সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবেন।

নতুন এই সরকারে ১৭ জন উপদেষ্টা রয়েছেন, যাদের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুইজন সমন্বয়কও রয়েছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নাম আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল।

এ তালিকায় যারা রয়েছেন, তাদের মধ্যে আছেন – বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল, মানবাধিকার কর্মী আদিলুর রহমান খান, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন এবং সাবেক নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন।বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ, উবিনীগের নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার এবং ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুর্শিদ। এছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া রয়েছেন এই তালিকায়। ইতিমধ্যে তাদের মধ্যে দপ্তর বন্টণ করে প্রজ্ঞাপন জারী করা হয়েছে।

এখানে দেখুন- অন্তর্বর্তী সরকারে কে কোন মন্ত্রণালয় পেয়েছেন?

এর বাইরে, শপথ গ্রহণের জন্য আরও ডাক পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ফারুক-ই-আজম, গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর জাহান বেগম, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান সুপ্রদীপ চাকমা, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ডা. বিধান রঞ্জন রায় এবং হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক নায়েবে আমীর আ ফ ম খালিদ হোসেন।

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতা, উদ্দেশ্য ও কার্যাবলী

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি বিশেষ সরকারী ব্যবস্থা, যা সাধারণত নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে গঠিত হয়। এই ধরনের সরকারের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করা, যাতে সকল রাজনৈতিক দল ও জনগণের আস্থা থাকে। তবে, এই ব্যবস্থার বৈধতা, গঠন এবং কার্যাবলী নিয়ে বিতর্কের কোনও শেষ নেই। সংবিধান এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে এই ব্লগে আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতা, উদ্দেশ্য, কার্যাবলী এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করব।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধারণা:

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হল একটি বিশেষ সরকারী ব্যবস্থা, যা নির্বাচনের পূর্বে ও নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীন সরকারের দায়িত্ব নেয়। এর মূল লক্ষ্য হল নির্বাচনকে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু করতে সহায়তা করা, যাতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নিরপেক্ষতা বজায় থাকে এবং সাধারণ জনগণের ভোটের অধিকার সুরক্ষিত হয়।

সংবিধান ও সুপ্রিম কোর্টের মতামত:

বাংলাদেশের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা প্রথম অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৯৬ সালে। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীতে এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। এর অধীনে, একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচনের সময় ক্ষমতা গ্রহণ করবে এবং সেই সময়ে নিয়মিত সরকারকে সমস্ত কার্যকলাপ থেকে বিরত রাখবে। তবে, ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করা হয়।

২০১১ সালের ১০ মে, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ ঘোষণা করে। তবে, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ায়, এই ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।

ইউনুস সরকারের বৈধতা:

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাংলাদেশে একসময় ছিল সংবিধানসম্মত, তবে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তা বাতিল হওয়ার পর এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সুপ্রিম কোর্টের মতে, এই ব্যবস্থা ছিল সংবিধানের মূল কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক, কারণ এটি সংসদীয় গণতন্ত্রের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

তবে ২০২৪ সালের ডঃ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত হওয়া সরকার বৈধ বলে মত দিয়েছেন সুপ্রীম কোর্ট-

শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। ফলে সংসদ না থাকা অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যায় কিনা, এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের কাছে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মতামত চেয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি। এরই ধারাবাহিকতায় ৮ আগস্ট প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পক্ষে মত দেন ও রুলিং ইস্যু করেন।

জানা গেছে, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মতামত দিয়ে বলেন, সংসদ না থাকা অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টা ও কয়েকজন উপদেষ্টা নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে। আপিল বিভাগের এই মতামত পাওয়ার পর বৃহস্পতিবার রাতে উপদেষ্টাদের শপথবাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি।

‘সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যদি কোনও সময়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতীয়মান হয় যে, আইনের এইরূপ কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হইয়াছে বা উত্থাপনের সম্ভাবনা দেখা দিয়াছে, যাহা এমন ধরনের ও এমন জনগুরুত্বসম্পন্ন যে, সেই সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন, তাহা হইলে তিনি প্রশ্নটি আপিল বিভাগের বিবেচনার জন্য প্রেরণ করিতে পারিবেন এবং উক্ত বিভাগ স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত শুনানির পর প্রশ্নটি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে স্বীয় মতামত জ্ঞাপন করিতে পারিবেন।’

তবে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এএনআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ সরকারকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে বলেন,

“আমরা দ্রুত গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা চাই। বর্তমানে এই সরকার সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক। ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর দ্বারা নির্বাচিত সরকারের কোনো বিধান নেই, কারণ বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি, এবং ২০,০০০ থেকে ৫০,০০০ বিক্ষোভকারী একটি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু। এই সরকারের জন্য কেউ ভোট দেয়নি।”

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশ্য:

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল উদ্দেশ্য হল নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সময় সকল রাজনৈতিক দলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা এবং একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা। এটি নির্বাচন পরিচালনায় সহায়তা করে এবং বর্তমান সরকারের হাতে ক্ষমতা রেখে নির্বাচনের সম্ভাব্য কারচুপি প্রতিরোধ করে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যাবলী:

১. নির্বাচন আয়োজন: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান দায়িত্ব হল নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজন করা এবং এটি যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু হয় তা নিশ্চিত করা।

  1. নিরপেক্ষ প্রশাসন: নির্বাচনের সময় প্রশাসনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা এবং কোনও প্রকার পক্ষপাতিত্ব থেকে বিরত থাকা।
  2. আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা: নির্বাচনের সময় আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, যাতে কোনও প্রকার সহিংসতা বা অবৈধ কার্যকলাপ না ঘটে।
  3. গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকা: নির্বাচনের সময় কোনও বড় ধরনের সিদ্ধান্ত না নেওয়া যাতে ভবিষ্যৎ সরকারের উপর কোনও চাপ সৃষ্টি না হয়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট:

বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালুর প্রধান কারণ ছিল ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচন। ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর, রাজনৈতিক দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়েছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দলগুলো নির্বাচন বর্জন করায় এবং আন্দোলনের চাপে ত্রয়োদশ সংশোধনী প্রণয়ন করা হয়।

তবে, সময়ের সাথে সাথে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ২০০৭-২০০৮ সালে সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দুই বছরের দীর্ঘ শাসন এবং এর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়া এবং নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদদের গ্রেফতারের ফলে এই ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক আরো গভীর হয়।

g1f6e59c766ca5c128c3b4db7739a8c2bd95c1fab41a324a8e66936ee38e6417e0c353d26ce4c6c41fa5879075baaa330_640-101280.jpg

উপসংহার:

বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা একসময় সংবিধানসম্মত ছিল এবং এর মূল উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনকে নিরপেক্ষভাবে আয়োজন করা। তবে, সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং পরবর্তীতে সংবিধান থেকে এই ব্যবস্থা বাদ দেয়ায় এর বৈধতা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা এবং কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্ক এখনো চলমান। ভবিষ্যতে এই বিষয়ে একটি সর্বজনগ্রহণযোগ্য সমাধান বের করা দেশের গণতন্ত্র এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তালিকা ২০২৪ লিস্ট

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ কত দিন?

আরও পড়ুন- বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ধারাবাহিক ইতিহাস (১৯৪৭-১৯৭১)

3 thought on “ডঃ ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কী বৈধ?”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *