বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম।
সম্মানিত সভাপতি,
বিশিষ্ট অতিথিবৃন্দ,
প্রিয় সহকর্মী, ছাত্রসমাজ এবং উপস্থিত সবাই,

আসসালামু আলাইকুম।

আমরা আজ এক গৌরবময় ইতিহাস স্মরণ করতে এখানে একত্রিত হয়েছি। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান আমাদের জাতীয় জীবনে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং মানুষের অধিকার পুনরুদ্ধারের সংগ্রামের প্রতীক। এটি ছিল ছাত্রসমাজ এবং সাধারণ জনগণের অদম্য সাহস, একতা এবং আত্মত্যাগের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়।

প্রিয় বন্ধুগণ,

শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবু সাঈদসহ সকল শহীদকে, যাঁদের ত্যাগ আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে নতুন দিশা দেখিয়েছে। গভীর শ্রদ্ধা জানাই তাদের প্রতি, যাঁরা তাদের জীবন উৎসর্গ করে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছেন। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি ছাত্র-জনতার সেই অমর সন্তানদের, যাঁদের আত্মত্যাগ জাতির ইতিহাসে চিরজ্বলন্ত প্রদীপ হয়ে থাকবে।


পটভূমি: কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সরকার পতনের আন্দোলন

সম্মানিত শ্রোতাগণ,
২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ একটি নতুন গণজাগরণের সূচনা করেছিল। তরুণ প্রজন্ম ন্যায়বিচার এবং সমতা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।

এই আন্দোলন তরুণদের মনে নেতৃত্বের প্রেরণা এবং রাজনৈতিক সচেতনতার বীজ বপন করে। যদিও আন্দোলনটি কিছু দাবির আংশিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে শেষ হয়, এটি জাতীয় রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে।

পরবর্তী সময়ে দেশের রাজনীতিতে নির্বাচন প্রক্রিয়ার কারচুপি, দুর্নীতি, এবং স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ ছাত্রসমাজ এবং জনসাধারণকে আরও বৃহত্তর আন্দোলনের পথে নিয়ে যায়। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে এই ক্ষোভ চূড়ান্ত রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে।

এই আন্দোলন পরিণত হয় এক গণ-অভ্যুত্থানে। ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে এই অভ্যুত্থানে যোগ দেয় শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবী এবং দেশের সাধারণ মানুষ।


জুলাই অভ্যুত্থানের ইতিহাস

জুলাই অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা, যেখানে ছাত্রসমাজ এবং সাধারণ জনগণ একসঙ্গে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য আন্দোলনে যোগ দেয়। ২০২৪ সালের ২৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে এই অভ্যুত্থান শুরু হয়, যা দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা সুষ্ঠু নির্বাচন, বাকস্বাধীনতা, এবং মানবাধিকারের সুরক্ষার দাবিতে রাস্তায় নামে। সরকারের কঠোর দমননীতি, লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস, এবং গ্রেফতারের পরও আন্দোলনকারীরা পিছু হটেনি। ৩১ জুলাই, ছাত্র-জনতার ঐক্যের চাপে জাতীয় আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। অভ্যুত্থানের ফলে ৩৬ জুলাই সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং অবাধ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেয়। এই অভ্যুত্থান ছিল ছাত্র-জনতার ত্যাগ, সাহসিকতা, এবং গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এটি দেশজুড়ে ঐক্যের বার্তা ছড়িয়ে দেয় এবং তরুণ প্রজন্মকে রাজনীতিতে নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করে। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জাতি নতুন এক রাজনৈতিক চেতনার পথপ্রদর্শক পায়। জুলাই অভ্যুত্থান বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পথে এক স্থায়ী অনুপ্রেরণা হয়ে রয়েছে।

মূল ঘটনাপ্রবাহ:

  1. ২৭ জুলাই, ২০২৪: ঢাকার রাজপথে হাজারো ছাত্র-জনতার মিছিল।
  2. ২৮ জুলাই: জাতীয় ধর্মঘট ঘোষণা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার দাবি।
  3. ২৯ জুলাই: আন্দোলন দমন করতে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস এবং গ্রেফতার।
  4. ৩০ জুলাই: সরকার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছে।
  5. ৩১ জুলাই: জাতীয় পর্যায়ে আন্দোলন সর্বোচ্চ শক্তিতে পৌঁছায়।

ছাত্র-জনতার ঐক্যের সামনে প্রশাসন দিশেহারা হয়ে পড়ে। ৩৬ জুলাই, ২০২৪, অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত সফলতা আসে। সরকারের পদত্যাগ এবং নতুন নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি জাতিকে নতুন আশার আলো দেখায়।



জুলাই অভ্যুত্থানের পরিসমাপ্তি (৩৬ জুলাই)

৩৬ জুলাই ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই দিনটি শুধু একটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের নয়, বরং ছাত্রসমাজ এবং সাধারণ জনগণের সাহস, দৃঢ়তা এবং একতার বিজয় হিসেবে চিহ্নিত।

৩৬ জুলাই-এর তাৎপর্য

  1. গণতন্ত্রের বিজয়: ৩৬ জুলাই চিহ্নিত হয় বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এক ঐতিহাসিক দিন হিসেবে।
  2. ছাত্র-জনতার সাফল্য: এই দিনটি ছাত্র-জনতার ত্যাগ এবং ঐক্যের চূড়ান্ত সাফল্যের প্রতীক।
  3. স্বৈরতন্ত্রের পতন: ৩৬ জুলাই-এ সরকারের পদত্যাগের মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটে।
  4. নতুন আশা: এই দিনটি জাতিকে একটি নতুন সূচনা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য গণতন্ত্রের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।
  5. ঐতিহাসিক একতা: এটি জাতীয় ঐক্যের শক্তি এবং জনগণের গণতান্ত্রিক চেতনার উজ্জ্বল উদাহরণ।
  6. অধিকার প্রতিষ্ঠা: ৩৬ জুলাই জনগণের মৌলিক অধিকার এবং মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করার দিন।

এই দিনটি আমাদের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল।


জুলাই অভ্যুত্থানের ফলাফল

সম্মানিত শ্রোতাগণ,
জুলাই অভ্যুত্থানের ফলাফল বাংলাদেশের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে।

  1. গণতন্ত্রের বিজয়: দীর্ঘ একনায়কত্বের পর জনগণ গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধার করে।
  2. তরুণ নেতৃত্বের বিকাশ: ছাত্রসমাজ রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে।
  3. ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা: আন্দোলনের চাপে দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা হয়।
  4. সাংবিধানিক সংস্কার: সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণীত হয়।

জুলাই অভ্যুত্থানের গুরুত্ব

জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের জাতীয় জীবনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এটি আমাদের শিখিয়েছে যে, ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়।

  1. গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার: জুলাই অভ্যুত্থান বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনা পুনরুদ্ধারের এক যুগান্তকারী অধ্যায়।
  2. ছাত্র নেতৃত্বের শক্তি: এই অভ্যুত্থান তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বের সক্ষমতা এবং জাতীয় রাজনীতিতে তাদের ভূমিকার প্রমাণ দেয়।
  3. ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা: এটি আমাদের সমাজে ন্যায়বিচার এবং সমতার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
  4. ঐক্যের শক্তি: অভ্যুত্থান জাতিকে দেখিয়েছে যে, ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সবচেয়ে শক্তিশালী অন্যায়ের অবসান ঘটানো সম্ভব।
  5. সাংবিধানিক সংস্কার: অভ্যুত্থানের চাপে নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং সংবিধানের ন্যায়সংগত সংস্কারের পথ সুগম হয়।
  6. স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার: এটি জনগণের বাকস্বাধীনতার প্রতি সরকারের বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করে।
  7. তরুণ প্রজন্মের প্রেরণা: ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটি একটি উদাহরণ এবং প্রেরণার উৎস হয়ে আছে।
  8. গণজাগরণের প্রতীক: অভ্যুত্থান গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতি জনগণের অটল অঙ্গীকারকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
  9. ত্যাগের মহিমা: অভ্যুত্থানটি ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ এবং সাহসিকতার মহিমা বহন করে।
  10. দেশগঠনের ভিত্তি: এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, গণতন্ত্র এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সবার দায়িত্ব একসাথে কাজ করা।

এই অভ্যুত্থানের স্মরণে আমার লেখা একটি কবিতার কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি:

স্বাধীনতার নতুন ডাক-

আজ নব উত্থান

পুনঃপ্রতিষ্ঠা পেল স্বদেশ

বাঙ্গালির বীরত্ব-সম্মান।”


পড়ুন- জুলাই অভ্যুত্থানের কবিতা ৩৬ জুলাই


জুলাই অভ্যুত্থানের ভবিষ্যত

জুলাই অভ্যুত্থান শুধু ইতিহাসের ঘটনা নয়; এটি একটি চলমান প্রেরণা। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, এই আন্দোলনের অর্জনগুলো রক্ষা পায়। গণতন্ত্রের যে বীজ রোপিত হয়েছে, তাকে সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও শক্তিশালী করতে হবে।


ছাত্র-জনতার ত্যাগের মহিমা

ছাত্র-জনতার ত্যাগের মহিমা বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে এক চিরস্মরণীয় অধ্যায় হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। তাদের আত্মত্যাগ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, জাতীয় মুক্তি এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য ত্যাগই সর্বোচ্চ মূল্য। এই অভ্যুত্থানে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ জীবন উৎসর্গ করে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছেন। তাদের সাহসিকতা ও আত্মদান ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করতে অনুপ্রাণিত করবে। ছাত্র-জনতার এই ত্যাগ আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের একটি অংশ এবং এটি আমাদের চেতনার মূল ভিত্তি।


আরও দেখুন- স্বাগত বক্তব্য দেয়ার নিয়ম || শুভেচ্ছা বক্তব্য কীভাবে দিবেন || Welcome speech in Bangla


জুলাই অভ্যুত্থানের শিক্ষা নিয়ে দেশগঠণ

সম্মানিত উপস্থিতগণ,
জুলাই অভ্যুত্থান থেকে আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি:

  1. গণতান্ত্রিক অধিকার কেবল অর্জন নয়, তা রক্ষাও করতে হয়।
  2. তরুণ প্রজন্ম জাতির মূল শক্তি।
  3. ঐক্য এবং সংগঠিত প্রচেষ্টা বড় পরিবর্তনের মূল চাবিকাঠি।

দেশগঠনের আহ্বান ও আগামী দিনের সম্ভাবনা

প্রিয় শ্রোতাগণ,
আসুন, আমরা সবাই মিলে এক নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলি। একটি এমন বাংলাদেশ, যেখানে ন্যায়, গণতন্ত্র এবং মানুষের অধিকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়।

আমাদের তরুণ প্রজন্মের মাঝে রয়েছে অসীম সম্ভাবনা। সঠিক দিকনির্দেশনা এবং ঐক্যের মাধ্যমে আমরা ভবিষ্যৎকে আরও উজ্জ্বল করে তুলতে পারি।


সমাপ্তি ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন

পরিশেষে, আমি এই কথাটি বলতে চাই—জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের শিখিয়েছে যে, গণতন্ত্রের যাত্রা কখনোই সহজ নয়। তবে, ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা এবং দৃঢ় মনোবল দিয়ে আমরা যেকোনো বাধা অতিক্রম করতে পারি।

ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *