একুশে ফেব্রুয়ারি: আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও জাতীয় শহিদ দিবস উপলক্ষে একটি পূর্ণাঙ্গ ভাষণ
প্রিয় পাঠক, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের শুভেচ্ছা নিন। এই ব্লগে একুশে ফেব্রুয়ারি আলোচনা অনুষ্ঠান উপলক্ষে নমুনা বক্তব্য প্রদান করা হল। জাতীয় জীবনে একুশের চেতনা বা অমর ২১শে ফেব্রুয়ারি বা শহিদ দিবসএর বক্তব্য বা বক্তৃতা বা ভাষণ উপস্থাপন করছি আমি –ময়নুল ইসলাম শাহ্ । আশা করি আপনাদের কাজে লাগবে।

সম্ভাষণ
মাননীয় সভাপতি, সম্মানিত অতিথিগণ, প্রিয় সহকর্মী এবং প্রিয় শিক্ষার্থীবৃন্দ—উপস্থিত সবাইকে জানাই একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের শুভেচ্ছা। আপনাদের সবার প্রতি রইল আমার আন্তরিক সালাম, আসসালামু আলাইকুম/ আদাব।
আজ ২১শে ফেব্রুয়ারি, আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের এক অনন্য দিন। আজকের এই দিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি সেই মহান ভাষা শহিদদের প্রতি, যাঁরা তাঁদের জীবন ও রক্ত দিয়ে আমাদের মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেই সাথে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি বাংলাদেশের সকল মুক্তি-সংগ্রামে যারা প্রাণ নিবেদন করেছেন তাদের আত্মত্যাগ।
সম্মানিত সুধী,
এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ভাষা কেবল কথার মাধ্যম নয়; এটি আমাদের পরিচয়, আমাদের আত্মার প্রতীক। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং নাম না-জানা আরও অনেকের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে পেরেছি। তাদের এই আত্মত্যাগ আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকবে। আমাদের ভাষা শহিদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি আজকের আলোচনা শুরু করছি।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও পটভূমি
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পর পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়। পূর্ব বাংলার মানুষ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু তাদের মাতৃভাষা বাংলার প্রতি কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের সরকার ঘোষণা করল যে উর্দু হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এই ঘোষণাটি পূর্ব বাংলার মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।
প্রিয় শ্রোতাগণ,
বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর এই আগ্রাসনের প্রতিবাদে ১৯৪৮ সাল থেকেই বিভিন্ন আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয়। ছাত্র সমাজ, শ্রমিক, কৃষকসহ সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে।
সেদিন পুলিশ বাঙালিদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলি চালায়। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেকে শহিদ হন। তাদের এই আত্মত্যাগ বাঙালির হৃদয়ে গভীর চিহ্ন রেখে যায়। ভাষা আন্দোলনের এই সংগ্রাম পরবর্তীতে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি স্থাপন করে।
ভাষা শহিদদের স্মরণে কিছু কথা
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি,
আমি কি ভুলিতে পারি।”
প্রিয় শ্রোতাবৃন্দ,
এই গানটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় শহিদদের আত্মত্যাগ। তাদের তাজা রক্তের বিনিময়ে আমরা বাংলাকে আমাদের মাতৃভাষার স্বীকৃতি দিয়েছি। ভাষা শহিদদের প্রতি আমাদের ঋণ শোধ করা সম্ভব নয়। তাদের আত্মত্যাগ আমাদের শিক্ষা দেয় যে ভাষা কেবল কথোপকথনের মাধ্যম নয়; এটি আমাদের পরিচয়, আমাদের অস্তিত্ব।
একুশের চেতনা: আমাদের পরিচয় ও গর্ব
অমর একুশের চেতনা আমাদের বলে দেয় যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিভাবে রুখে দাঁড়াতে হয়। এটি আমাদের সাহস, আত্মসম্মান এবং ঐক্যের প্রতীক। একুশ আমাদের শিখিয়েছে যে মাতৃভাষা রক্ষার জন্য জীবন দেওয়াও সার্থক।
একুশের চেতনা আমাদের সংস্কৃতি, সাহিত্য এবং ঐতিহ্যকে রক্ষা করার প্রেরণা যোগায়। এটি আমাদের গর্ব এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষার এক অসীম উৎস।
একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক গুরুত্ব
প্রিয় শ্রোতাবৃন্দ,
১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী ভাষার বৈচিত্র্য ও মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নতুন মাত্রা যোগ করে। আজ, সারা বিশ্বে এই দিনটি পালিত হয় ভাষার অধিকার ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের রক্ষার প্রতীক হিসেবে।
আমাদের করণীয়: একুশের চেতনার বাস্তবায়ন
আজকের দিনে আমাদের দায়িত্ব হলো:
১. বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা।
২. প্রযুক্তি, সাহিত্য এবং শিক্ষায় বাংলার প্রয়োগ বাড়ানো।
৩. শিশুদের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলা।
৪. বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া।
শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি পালনে সীমাবদ্ধ না থেকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মাতৃভাষার প্রয়োগ বাড়াতে হবে।
নতুন প্রজন্মের দায়িত্ব
তরুণ প্রজন্ম,
তোমাদের প্রতি আহ্বান:
- তোমরা বাংলা ভাষাকে ভালবাসবে।
- প্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলাকে আরো উন্নত করো।
- বাংলা সাহিত্য পড়ো এবং নতুন প্রজন্মকে তা শিখতে উৎসাহিত করো।
- তোমাদের কাজের মাধ্যমে একুশের চেতনাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরো।
কবিতাংশ: একুশের প্রেরণা
শ্রোতাগণ,
একুশ আমাদের অনুভূতির প্রতীক। কবিতার ভাষায় বলতে চাই:
“শহিদের রক্তে লেখা ইতিহাস,
যুগে যুগে বলবে বারবার,
ভাষার জন্য যারা দিয়েছে প্রাণ,
তাদের নাম জ্বলুক নক্ষত্রসম।”
আরও পড়ুন- একুশে ফেব্রুয়ারির ৪টি কবিতা
বিদায়ি সম্ভাষণ
সম্মানিত শ্রোতাবৃন্দ,
আজকের দিনটি আমাদের জন্য গর্বের, তবে এটি আমাদের জন্য দায়িত্বেরও। আসুন, আমরা সবাই মিলে একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আমাদের মাতৃভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করি। ভাষা শহিদদের আত্মত্যাগ যেন বৃথা না যায়, তা নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব।
এই মহান দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ভাষা শুধুমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম নয়; এটি আমাদের পরিচয়, আমাদের গর্ব। তাই আসুন, একুশের চেতনাকে ধারণ করি এবং আমাদের জাতিকে আরও উন্নতির দিকে নিয়ে যাই।
ধন্যবাদ।
[…] […]