Push Cart and a White Paperbag

ময়নুল ইসলাম শাহ্‌


ভোক্তা সুরক্ষা কী?

ভোক্তা সুরক্ষা হল এমন একটি কাঠামো যার মাধ্যমে সাধারণ জনগণের অধিকার সংরক্ষিত হয়। ভোক্তা সুরক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল এমন ব্যবস্থা তৈরি করা যেখানে ভোক্তা প্রতারণা, মানহীন পণ্য বা সেবা, এবং ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পায়। বাংলাদেশে এই সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ চালু করা হয়, যার মাধ্যমে ভোক্তারা তাদের ক্ষতিগ্রস্ত পণ্য বা সেবার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারেন এবং ন্যায্য ক্ষতিপূরণের দাবি করতে পারেন।


ভোক্তার অধিকার সমূহ

১. গুণগত মানের অধিকার:
ভোক্তারা এমন পণ্য এবং সেবা পাওয়ার অধিকার রাখেন যা তাদের প্রয়োজন এবং প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম। গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য সরকার নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করেছে, যা পণ্য উৎপাদন এবং সেবা প্রদানকারীদের মান বজায় রাখতে বাধ্য করে।

২. তথ্য জানার অধিকার:
ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ আইন অনুসারে, ভোক্তাদের পণ্য বা সেবা সম্পর্কিত সকল গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে হবে। এতে পণ্যের উপাদান, ব্যবহার, ক্ষতিকর উপাদান, উৎপাদন এবং মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ অন্তর্ভুক্ত। ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।

  1. নিরাপত্তার অধিকার:
    ভোক্তাদের জীবন, স্বাস্থ্য এবং সম্পদ রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল নিরাপত্তা বিধান মেনে পণ্য ও সেবা সরবরাহ করতে হয়। মানহীন বা ঝুঁকিপূর্ণ পণ্য সরবরাহ করলে সেই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়।
  2. বিকল্প বাছাইয়ের অধিকার:
    ভোক্তারা স্বাধীনভাবে সেরা পণ্য বা সেবা বেছে নেয়ার অধিকার রাখেন। এই অধিকার নিশ্চিত করতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তাদের সেবার গুণগত মান এবং প্রাসঙ্গিক তথ্য সঠিকভাবে প্রকাশ করতে বাধ্য।
  3. ক্ষতিপূরণের অধিকার:
    ক্ষতিগ্রস্ত হলে ভোক্তারা ক্ষতিপূরণের জন্য আদালত বা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে আবেদন করতে পারেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তাদের আর্থিক পুনর্বাসন নিশ্চিত করা হয়।
  4. শিক্ষা ও সচেতনতার অধিকার:
    ভোক্তাদের অধিকার সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকা জরুরি। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ এবং ভোক্তা অধিকার সংস্থাগুলোর প্রচার ও কর্মসূচির মাধ্যমে ভোক্তাদের সচেতন করা হয়।

ভোক্তা অধিকার অভিযোগ করার নিয়ম

যদি কোনো ভোক্তা কোনো পণ্য বা সেবার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হন, তবে তারা নির্দিষ্ট নিয়মে অভিযোগ করতে পারেন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করতে নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করুন:

  1. লিখিত আবেদন করতে হবে: আপনার অভিযোগটি বিস্তারিত লিখে, ক্রয় রশিদসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কাগজপত্র যুক্ত করুন।
  2. অভিযোগ দাখিলের পদ্ধতি:
    • সরাসরি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কার্যালয়ে জমা দিতে পারেন। অথবা,
    • অনলাইনে অভিযোগ করতে ওয়েবসাইট বা ই-মেইল ব্যবহার করুন। অথবা,
    • ফোনে অভিযোগের জন্য ১৬১২১ নাম্বারে যোগাযোগ করুন।
  3. সময়সীমা: পণ্য বা সেবা গ্রহণের ৩০ দিনের মধ্যে অভিযোগ করুন।
  4. ফলাফল: অভিযোগ প্রমাণিত হলে জরিমানার ২৫% ভোক্তাকে প্রদান করা হয়।

ভোক্তা অধিকার অনলাইন অভিযোগ করার প্রক্রিয়া

অনলাইন অভিযোগের সুবিধার মাধ্যমে ভোক্তারা ঘরে বসেই অভিযোগ করতে পারেন। অনলাইনে অভিযোগ করতে:

  • ওয়েবসাইটে যান: প্রথমে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে (https://dncrp.portal.gov.bd/) যান।
  • অভিযোগ ফর্ম পূরণ করুন: নির্ধারিত ফর্ম পূরণ করে, পণ্যের তথ্য, অভিযোগের ধরন, এবং ছবি বা প্রমাণসহ আবেদন জমা দিন।
  • ফোন নাম্বার: অভিযোগ বিষয়ে সহায়তা পেতে সরাসরি ১৬১২১ নাম্বারে যোগাযোগ করা যায়।

যেখানে অভিযোগ দায়ের করা যাবে
অভিযোগ পাঠাতে পারবেন এই ঠিকানায়-

মহাপরিচালক, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ১ কারওয়ান বাজার (টিসিবি ভবন-৮ম তলা), ঢাকা, ফোন: +৮৮০২ ৮১৮৯৪২৫। এছাড়াও এই ঠিকানায় অভিযোগ পাঠাতে পারবেন। জাতীয় ভোক্তা অভিযোগ কেন্দ্র,  টিসিবি ভবন- ৯ম তলা, ১ কারওয়ান বাজার ঢাকা, ফোন: ০১৭৭৭ ৭৫৩৬৬৮, ই-মেইল: nccc@dncrp.gov.bd।
 
চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, টিসিবি ভবন, বন্দরটিলা, চট্টগ্রাম, ফোন: ০৩১-৭৪১২১২

রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, শ্রীরামপুর, রাজশাহী, ফোন: +৮৮০৭ ২১৭৭২৭৭৪

খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, টিসিবি ভবন, শিববাড়ী মোড়, খুলনা, ফোন: ০৪১-৭২২৩১১

রিশাল বিভাগীয় কার্যালয়, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, মহিলা ক্লাব ভবন, বরিশাল, ফোন: +৮৮০৪ ৩১৬২০৪২

উপ পরিচালক, সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, সিলেট ফোন: ০৮২১-৮৪০৮৮৪

উপ পরিচালক, রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, নিউ ইঞ্জিনিয়ার পাড়া, রংপুর, ফোন: ০৫২১-৫৫৬৯১


ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর গুরুত্বপূর্ণ ধারাসমূহ

১. ধারা ৩৭ (অপর্যাপ্ত পণ্য বা সেবার জন্য জরিমানা):
যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মানহীন পণ্য বা সেবা প্রদান করে এবং তাতে ভোক্তার ক্ষতি হয়, তবে তাকে শাস্তির আওতায় আনা হয়। ক্ষতির পরিমাণ বুঝে জরিমানা আরোপ করা হয়।

  1. ধারা ৩৮ (পণ্যের মানহীনতা ও ভেজাল সনাক্ত):
    ভেজাল পণ্যের বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর নিয়মিত অভিযান চালায়। পণ্যের মানহীনতা প্রমাণিত হলে জরিমানা এবং সেই পণ্য বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হয়।
  2. ধারা ৪০ (সঠিক তথ্য প্রদানের বাধ্যবাধকতা):
    পণ্য বা সেবা সম্পর্কিত তথ্য ভোক্তাকে সঠিকভাবে সরবরাহ করতে হবে। তথ্য গোপন বা মিথ্যা তথ্য প্রদান করলে আইনের আওতায় শাস্তির বিধান রয়েছে।
  3. ধারা ৪২ (ভোক্তাদের প্রতারণার জন্য শাস্তি):
    ভোক্তাকে প্রতারণা করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃতভাবে ভোক্তাকে ঠকায়, তবে তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়।

প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়

ভোক্তা সুরক্ষায় আইন প্রণয়ন যথেষ্ট নয়, সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে প্রচারণা চালাচ্ছে। মিডিয়ার ভূমিকা, সচেতনতামূলক কর্মসূচি, এবং পণ্য বা সেবার মান পর্যালোচনার মাধ্যমে ভোক্তা সুরক্ষায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।


উপসংহার

এই আইনি কাঠামো ভোক্তাদের শক্তিশালী করে, এবং দেশের ভোক্তা সুরক্ষা ব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে উন্নত হচ্ছে।

আরও পড়ুন- বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আইন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।