মুসলিম পারিবারিক আইনে সন্তানের প্রতি পিতামাতার দায় দায়িত্ব
ব্লগঃ ময়নুল ইসলাম শাহ্
ভূমিকা
পারিবারিক আইনে সন্তানের হেফাজত (custody) ও ভরণ-পোষণ (maintenance) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনো বৈবাহিক সম্পর্কের বিচ্ছেদ হলে সন্তানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা হয় আইন অনুসারে। এই ব্লগে আমরা বাংলাদেশের পারিবারিক আইনের অধীনে সন্তানের হেফাজত ও ভরণ-পোষণের বিধানগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।
সন্তানের হেফাজত আইন: কীভাবে সিদ্ধান্ত হয়?
বাংলাদেশের পারিবারিক আইন অনুসারে, সন্তানের হেফাজত মূলত নির্ভর করে তার কল্যাণের ওপর। আদালত সন্তানের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কোন পিতা-মাতার কাছে থাকা নিরাপদ এবং সঠিক হবে তা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়।
হেফাজতের সংজ্ঞা
হেফাজত বলতে বোঝানো হয় সন্তানের সঙ্গে কার বসবাসের অধিকার থাকবে এবং কে তাকে দৈনন্দিন জীবনযাপন, শিক্ষা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে নেতৃত্ব দেবে।
আইনগত ধারা:
- গার্ডিয়ান অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট, ১৮৯০ (Guardian and Wards Act, 1890): এই আইন সন্তানের হেফাজত সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ আইন হিসেবে বিবেচিত।
- মুসলিম পার্সোনাল ল (শরীয়ত) অ্যাপ্লিকেশন অ্যাক্ট, ১৯৩৭: মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের অধীনে সন্তানের হেফাজত নির্ধারিত হয়।
সিদ্ধান্তের সময় আদালত যেসব বিষয় বিবেচনা করে:
- সন্তানের বয়স: সাধারণত, মা-কে সন্তানের হেফাজত দেওয়া হয় যদি সন্তান ৭ বছরের নিচে হয়।
- সন্তানের পছন্দ: বয়স্ক সন্তানদের মতামতও বিবেচনা করা হয়।
- পিতামাতার আর্থিক অবস্থা: সন্তানের ভরণ-পোষণের জন্য অর্থনৈতিক সামর্থ্য গুরুত্বপূর্ণ।
সন্তানের ভরণ-পোষণ: কীভাবে নির্ধারণ হয়?
ভরণ-পোষণ বলতে বোঝানো হয় সন্তানের প্রয়োজনীয় জীবনযাত্রার মান বজায় রাখার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান। বিচ্ছেদের পরে, যেই পিতা-মাতা সন্তানের হেফাজত পাননি, তাকে সাধারণত সন্তানের ভরণ-পোষণ করতে হয়।
আইনগত ধারা:
- মুসলিম পার্সোনাল ল (শরীয়ত) অ্যাপ্লিকেশন অ্যাক্ট, ১৯৩৭ (ধারা অনুযায়ী): মুসলিম আইন অনুসারে পিতা সাধারণত সন্তানের ভরণ-পোষণের জন্য দায়ী।
- মেইনটেনেন্স অব চিলড্রেন অ্যাক্ট, ১৯৭৬: এই আইন সন্তানের ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করার জন্য প্রযোজ্য হয়।
বিচারক কী কী বিষয় বিবেচনা করেন?
- সন্তানের প্রয়োজন: শিক্ষা, খাদ্য, চিকিৎসা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খরচ।
- পিতামাতার উপার্জন: উভয় পিতামাতার উপার্জনের ভিত্তিতে ভরণ-পোষণের পরিমাণ নির্ধারণ হয়।
হেফাজত ও ভরণ-পোষণ নিয়ে আদালতে আবেদন
আদালতের ধরণ: বাংলাদেশে পারিবারিক আদালতে সন্তানের হেফাজত ও ভরণ-পোষণ সংক্রান্ত মামলা দায়ের করা যায়। এই ধরনের মামলা সাধারণত পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এর অধীনে দায়ের হয়।
আবেদন পদ্ধতি: সন্তান হেফাজত বা ভরণ-পোষণের দাবিতে আবেদন করতে হলে আদালতে আবেদন ফর্ম পূরণ করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হয়। উভয় পক্ষের আইনজীবী যথাক্রমে যুক্তি উপস্থাপন করেন, এরপর বিচারক রায় প্রদান করেন।
সন্তানের ভরণ-পোষণ: পিতামাতার দায়িত্ব
বিচ্ছেদ বা তালাকের পর সন্তানের ভরণ-পোষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সন্তানের আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রে উভয় পিতামাতাই দায়বদ্ধ। বাবা বা মা যে পিতামাতা হেফাজত পাননি, তিনি সাধারণত সন্তানের ভরণ-পোষণের জন্য আদালতে নির্ধারিত অর্থ প্রদান করে থাকেন।
মাসিক ভরণ-পোষণ:
- সন্তানের বয়স এবং তার শিক্ষাগত প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে মাসিক ভরণ-পোষণ নির্ধারণ হয়।
- যদি পিতা বা মাতা আদালতের আদেশ অনুযায়ী ভরণ-পোষণ না দেন, তবে আদালত আইনানুগ পদক্ষেপ নিতে পারে।
বিবাহ-বিচ্ছেদের পরে স্ত্রীর ভরণপোষণ:
যদি কোনো কারণে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটেই যায় তাহলে বিবাহ-বিচ্ছেদের পরও স্ত্রী কিছুদিন ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী হবেন। মুসলিম আইনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হাইকোর্ট বিভাগ সিদ্ধান্ত নেয় যে, “স্বামীর অবশ্যই তার তালাক প্রদানকারী স্ত্রীকে এমনভাবে ভরণপোষণ দিতে হবে যা তার জন্য প্রয়োজন, এমনকি ইদ্দতকালিন সময় পার হওয়ার পরেও এই যথাযোগ্য ভরণপোষণ দিতে হবে একটি অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য যতদিন পর্যন্ত সেই তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর অন্য কোনো বিয়ে না হয়”। কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগের এই রায়কে দেশের সবোর্চ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ দ্বারা রহিত করা হয়। এই একই মামলায় আপিল বিভাগ শেষ পর্যন্ত বিবাহ-বিচ্ছেদের পর তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে কেবল তিন মাস (৯০ দিন) অর্থাৎ ইদ্দতকালিন সময় পর্যন্ত ভরণপোষণ দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
FAQ (প্রশ্ন ও উত্তর)
১. সন্তানের হেফাজতের ক্ষেত্রে পিতা-মাতা উভয়েরই কি সমান অধিকার আছে?
হ্যাঁ, উভয়ের অধিকার আছে। তবে আদালত সন্তানের সর্বোচ্চ কল্যাণ বিবেচনা করে হেফাজতের রায় দেয়।
২. ভরণ-পোষণের অর্থ প্রদান না করলে কি হবে?
যদি আদালতের আদেশ অনুযায়ী ভরণ-পোষণ না দেয়া হয়, তাহলে আদালত সেই পিতামাতার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে।
৩. সন্তানের হেফাজত কি পরিবর্তন হতে পারে?
হ্যাঁ, যদি সন্তানের কল্যাণের জন্য প্রয়োজন হয়, তাহলে আদালত পুনরায় হেফাজত পরিবর্তন করতে পারে।
৪. সন্তানের বয়স কত হলে তার মতামত নেওয়া হয়?
সাধারণত, ১২ বছরের বেশি বয়সী সন্তানের মতামত আদালত বিবেচনা করে।
৫. ডিভোর্স হলে সন্তান কে পাবে?
শরিয়তের বিধান হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে ছেলে সন্তানের বয়স সাত বছর এবং মেয়ে সন্তানের বয়স নয় বছর পর্যন্ত সন্তান তার মায়ের কাছে থাকবে। কিন্তু তার ভরণ পোষণের দায়িত্ব পিতার ওপর।
৬. সন্তানের ভরণপোষণ কত টাকা?
সন্তানের ভরণপোষণের পরিমাণ নির্ধারণ আদালতের ওপর নির্ভর করে এবং এটি পিতা-মাতার আর্থিক সামর্থ্য, সন্তানের প্রয়োজনীয়তা, এবং জীবনযাত্রার মান বিবেচনা করে ঠিক করা হয়। এটি মাসিক কয়েক হাজার টাকা থেকে শুরু করে অধিক পরিমাণও হতে পারে, যা সন্তানের শিক্ষা, চিকিৎসা, এবং অন্যান্য খরচ মেটানোর জন্য প্রযোজ্য।
উপসংহার
বাংলাদেশের পারিবারিক আইন সন্তানের হেফাজত ও ভরণ-পোষণের বিষয়ে স্পষ্ট বিধান প্রদান করে। সন্তানের কল্যাণকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে আদালত পিতা-মাতা এবং সন্তানের অধিকার সংরক্ষণ করে। হেফাজত বা ভরণ-পোষণ সংক্রান্ত সমস্যায় পড়লে আইনি পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
রেফারেন্স:
- গার্ডিয়ান অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট, ১৮৯০
- মুসলিম পার্সোনাল ল (শরীয়ত) অ্যাপ্লিকেশন অ্যাক্ট, ১৯৩৭
- পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫
এই ব্লগটি সন্তানের হেফাজত আইন এবং ভরণ-পোষণ নিয়ে বিস্তারিত ধারণা দেয়, যা পিতামাতাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
[…] পারিবারিক আইনে সন্তানের হেফাজত ও ভরণ-… The Political Perspective on Article 370: Implications for Kashmir and Indian Federalism Guide to the Indian Penal Code (IPC-1860): India’s Criminal Law বিশ্ব শিশু দিবসের বক্তব্য ২০ নভেম্বর ভাষণ যে কারণে বাতিল হয়েছে ৮টি জাতীয় দিবস […]