pexels-photo-14766052-14766052.jpg

বাংলাদেশে পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩ একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা পারিবারিক বিবাদ এবং সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। পরিবার হলো সমাজের মূল ভিত্তি, এবং পরিবারে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য একটি কার্যকর আইন প্রয়োজন। এই নতুন আইন প্রণয়ন করে সরকার পরিবারিক সমস্যা সমাধানে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। এই ব্লগে আমরা বাংলাদেশ পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

পারিবারিক আদালত: সংজ্ঞা ও উদ্দেশ্য

পারিবারিক আদালত হলো এমন একটি বিশেষ আদালত যেখানে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সংঘটিত বিবাদ এবং সমস্যা সমাধান করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো দ্রুত, কার্যকর, এবং মানবিকভাবে পরিবারিক সমস্যাগুলো সমাধান করা। পারিবারিক আদালত আইন২০২৩-এর ৫ ধারা মতে, পারিবারিক আদালতের এখতিয়ার রয়েছে যে কোনো বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত যেকোনো মামলার বিচার করার এবং নিষ্পত্তি করার, যেমন বিবাহবিচ্ছেদ, দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার, দেনমোহর, রক্ষণাবেক্ষণ এবং অভিভাবকত্ব এবং শিশুদের হেফাজত, যা একই থাকে আগের অধ্যাদেশ ১৯৮৫-এর ৫ ধারা হিসেবে।

১. পারিবারিক আদালতের সংজ্ঞা

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩ অনুযায়ী, পারিবারিক আদালত হল এমন একটি আদালত যেখানে বিবাহ, তালাক, দাম্পত্য অধিকার, সন্তানদের তত্ত্বাবধান, এবং পারিবারিক সহিংসতা সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে মামলা পরিচালিত হবে। পারিবারিক আদালতগুলি মূলত একটি আদালত অব ইক্যুইটি হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল যা শিশুদের হেফাজত সহ পারিবারিক আইন সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এবং আদেশ দেওয়ার জন্য আহ্বান করা হয়েছিল , এবং যতক্ষণ না আবেদনকারী/বাদী ” সাফ হাতে ” আদালতে আসেন ততক্ষণ পর্যন্ত কিছু আইনি প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করতে পারে। 

পারিবারিক আদালত কোন ধরনের মামলা মোকাবেলা করে?

পারিবারিক আদালতগুলি বিশেষ বিধি দ্বারা তৈরি করা হয় যা তাদের পরিচালনা করতে হবে এমন মামলার ধরনগুলিকে সংজ্ঞায়িত করে, যেমন-

  • বেশিরভাগ পারিবারিক আদালত বিবাহবিচ্ছেদ এর মামলা পরিচালনা এরে। 
  • দেওয়ানী আদালত মাঝে মাঝে শিশুর হেফাজত বা ভরণপোষণ প্রদানের পরিবর্তন নির্ধারণের জন্য পারিবারিক আদালতে এই জাতীয় মামলাগুলি পরিচালনা করে।
  • অভিভাবকত্ব, 
  • সন্তানের অবহেলা , 
  • কিশোর অপরাধ ,
  • পিতৃত্ব/ মাতৃত্ব
  • পারিবারিক অপরাধ ( যেমন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ বা ছোটখাটো আক্রমণ) জড়িত মামলা।

যদিও সম্পর্কিত বিষয়গুলি যেমন শিশু সহায়তা এবং হেফাজত পারিবারিক আদালত দ্বারা পরিচালনা করা যেতে পারে, বিবাহবিচ্ছেদের মামলাগুলি শুধুমাত্র সুপ্রিম কোর্টে শুনানি হয়।

মোহরানা বা দেনমোহর

মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১-এর ১০ ধারা অনুসারে, নিকাহনামা বা বিবাহের চুক্তিতে মোহরানা বা দেনমোহর পরিশোধের পদ্ধতি বিস্তারিত লিপিবদ্ধ না থাকলে সম্পূর্ণ মোহরানা চাওয়ামাত্র প্রদেয় বলে নির্ধারিত হবে। অর্থাৎ মুসলিম আইনে প্রাপ্য স্ত্রীর মোহরানা বা তার কোনো অংশের অধিকার কোনোভাবে ক্ষুণ্ন হবে না। স্ত্রী নিজে থেকে তালাক দিলেও দেনমোহর পাবেন। এমনকি স্ত্রীর মৃত্যু হলে স্ত্রীর উত্তরাধিকারীরা এই দেনমোহর পাওয়ার অধিকারী। দেনমোহর পাওয়ার জন্যও উত্তরাধিকারীরা মামলা করতে পারেন। শিশু সন্তানদের অভিভাবকত্ব ও তত্ত্বাবধানের জন্যও পারিবারিক আদালতে পারিবারিক মামলা দায়েরের মাধ্যমে বিজ্ঞ আদালত দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে।

২. বিচারকের ক্ষমতা ও দায়িত্ব

নতুন আইনে পারিবারিক আদালতের বিচারকদের ক্ষমতা ও দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে:

  • বিচার প্রক্রিয়া: পারিবারিক আদালতের বিচারকগণ সংক্ষিপ্ত ও দ্রুত প্রক্রিয়ায় মামলাগুলোর নিষ্পত্তি করবেন।
  • মানবিক দৃষ্টিকোণ: বিচারকগণ মানসিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে মামলাগুলোর সমাধান করবেন।
  • প্রামাণিক ব্যবস্থা: আইন অনুযায়ী বিচারকগণ প্রমাণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবেন।

৩. মামলা দায়ের এবং বিচার প্রক্রিয়া বা কীভাবে আইনী প্রতিকার পাবেন?

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩ অনুযায়ী, মামলা দায়ের এবং বিচার প্রক্রিয়ার নিয়মাবলী নির্ধারণ করা হয়েছে:

  • মামলা দায়ের: পারিবারিক আদালতে মামলার জন্য নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করে মামলা দায়ের করতে হবে।
  • বিচার প্রক্রিয়া: মামলা দায়েরের পর দ্রুততার সঙ্গে শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি হবে।
  • আপিল প্রক্রিয়া: পারিবারিক আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।

কীভাবে আইনী প্রতিকার পাবেন?

উভয় পক্ষ যেখানে বসবাস করে বা সর্বশেষ বসবাস করেছে এবং যে পারিবারিক আদালতের স্থানীয় সীমার মধ্যে সমস্যা উদ্ভূত হয়েছে, সেই আদালতে মামলা করতে হবে। তবে বিবাহবিচ্ছেদ, মোহরানা ও ভরণপোষণের ক্ষেত্রে যেখানে স্ত্রী বসবাস করেন, সেই এলাকায় বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে পারবেন। দেনমোহর বা ভরণপোষণের পরিমাণ যতই হোক, মামলা করা যাবে। পারিবারিক আদালতে আইন চর্চা করেন এমন একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে আবেদন করতে হবে। পারিবারিক আদালতে আশ্রয় নিতে হলে খুব বেশি কোর্ট ফি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থার যারা পারিবারিক বিষয়ে কাজ করে তাদের আইনজীবীর মাধ্যমেও আদালতে মামলা দায়ের করা যাবে। পারিবারিক আদালতের ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিলের বিধান থাকলেও বিবাহবিচ্ছেদের ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না। এ ছাড়া পাঁচ হাজার টাকার কম মোহরানার ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিল চলবে না। কোনো আবেদন পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে আদালত বাদী ও বিবাদীকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেবেন। আদালত প্রয়োজনে রুদ্ধদ্বার কক্ষেও বিচারের ব্যবস্থা করতে পারেন।

পারিবারিক আদালতে কখন যাবেন? https://www.prothomalo.com/lifestyle/%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%86%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A6%96%E0%A6%A8-%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%A8

৪. সন্তানদের তত্ত্বাবধান ও অধিকার

বিবাহ বিচ্ছেদের পর সন্তান কার কাছে থাকবে? ছেলেসন্তান ৭ বছর পর্যন্ত ও মেয়েসন্তান বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত মায়ের কাছে থাকবে। এবং বাবা ভরণপোষণ দিতে বাধ্য থাকবে। বাবা ভরণপোষণ না দিলে আদালতের মাধ্যমে মা তার সন্তানের ভরণপোষণ বাবার কাছ থেকে আদায় করতে পারেন। তবে বর্তমানে বিবাহ-বিচ্ছেদের পর সন্তান কার কাছে থাকবে তা আদালত তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করে নির্ধারণ করে থাকেন। বিজ্ঞ আদালত সন্তানের বয়সের বিষয়টি বিবেচনার পাশাপাশি কোথায় সন্তানের কল্যাণ নিশ্চিত হবে সে বিষয়ে বেশি নজর দেন। সে ক্ষেত্রে অনেক সময়ই সন্তানের বয়স মুখ্য বিষয় হয় না। নতুন আইনে সন্তানের তত্ত্বাবধান ও অধিকার সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে:

  • তত্ত্বাবধানের অধিকার: সন্তানের সর্বোত্তম স্বার্থে তত্ত্বাবধানের অধিকার প্রদান করা হবে।
  • দেখাশোনার অধিকার: সন্তানের দেখাশোনার অধিকার কিভাবে পালিত হবে তা আদালত নির্ধারণ করবে।
  • শিক্ষা ও স্বাস্থ্য: সন্তানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়গুলোতেও আদালতের নির্দেশনা থাকবে।

আইনের কার্যকারিতা এবং চ্যালেঞ্জ

নতুন পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩ কার্যকর করতে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

  • সচেতনতা বৃদ্ধি: জনগণের মধ্যে আইনের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
  • কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ: বিচারক এবং আইনজীবীদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
  • পর্যাপ্ত জনবল ও সম্পদ: আদালতের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত জনবল ও সম্পদ সরবরাহ করতে হবে।

উপসংহার

বাংলাদেশ পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩ পারিবারিক সমস্যা সমাধানে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। এই আইন কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে পরিবারে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হবে। তবে এর কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি জনগণেরও সচেতনতা ও সহযোগিতা প্রয়োজন। আইনটির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন করা সম্ভব হবে।

ভূমি আইন ২০২৩ দখল সংক্রান্ত অপরাধ ও প্রতিকার https://moynulshah.com/%e0%a6%ad%e0%a7%82%e0%a6%ae%e0%a6%bf-%e0%a6%86%e0%a6%87%e0%a6%a8-%e0%a7%a8%e0%a7%a6%e0%a7%a8%e0%a7%a9-%e0%a6%a6%e0%a6%96%e0%a6%b2-%e0%a6%b8%e0%a6%82%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%a8/

One thought on “নতুন পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩: সমস্যা ও প্রতিকার”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।