বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা: সংবিধান ও মানুষের মতামত- ময়নুল ইসলাম শাহ্
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। কোটা ব্যবস্থা সুবিধাবঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য একটি সংরক্ষিত ব্যবস্থা, যা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষকে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ দেয়। কোটা ব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক ও মতামত থাকলেও, এটি দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও সাংবিধানিক প্রেক্ষাপট।
কোটা ব্যবস্থার সাংবিধানিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৯ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সরকারি চাকরিতে সকল নাগরিকের সমান সুযোগ থাকার কথা বলা হয়েছে। তবে, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূল স্রোতে নিয়ে আসার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণেরও নির্দেশনা রয়েছে। এ ধারার ভিত্তিতেই সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।
কোটার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থার প্রচলন শুরু করা হয়। সে সময় মেধাতালিকা ২০ শতাংশ বরাদ্দ রেখে, ৪০ শতাংশ জেলাভিত্তিক, ৩০ শতাংশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য এবং ১০ শতাংশ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ নারীদের জন্য বরাদ্দ রেখে মোট ৮০ শতাংশ কোটা দেওয়া হয়। তবে এই ব্যবস্থা সাময়িক এবং অন্তর্বর্তীকালীন বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার এই কোটা ব্যবস্থাটির হিসেব নিকেশে পরিবর্তন নিয়ে আসা হয়।
কোটা ব্যবস্থার বর্তমান চিত্র
বর্তমানে, সরকারি চাকরিতে মোট পদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষিত রয়েছে। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা, নারী কোটা, উপজাতি কোটা, প্রতিবন্ধী কোটা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫৫ শতাংশের বেশি কোটা রয়েছে যার মধ্যে-
মুক্তিযোদ্ধা কোটা | ৩০ শতাংশ |
জেলাভিত্তিক কোটা | ১০ শতাংশ |
নারীদের জন্য নির্ধারিত কোটা | ১০ শতাংশ |
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য নির্ধারিত কোটা | ৫ শতাংশ |
সর্বমোট কোটা | ৫৫+১=৫৬ শতাংশ |
এদিকে-
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ১৯ (১), ২৯ (১) ও ২৯ (২) অনুচ্ছেদ সমূহে চাকুরির ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের সমান সুযোগের কথা বলা হয়েছে।
২০১৮ সালে ছাত্রদের ব্যাপক আন্দোলনের পর সরকার কোটা ব্যবস্থায় কিছুটা পরিবর্তন আনে, তবে কোটা সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করা হয়নি।
কোটা সংস্কারের দাবিগুলো কী?
‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র সংরক্ষণ পরিষদ’এর ব্যানারে যে পাঁচটি বিষয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলছে সেগুলো হল-
• কোটা-ব্যবস্থা ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা (আন্দোলনকারীরা বলছেন ৫৬% কোটার মধ্যে ৩০ শতাংশই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ। সেটিকে ১০% এ নামিয়ে আনতে হবে)
• কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া
• সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়স-সীমা- (মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ক্ষেত্রে চাকরীর বয়স-সীমা ৩২ কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য ৩০। সেখানে অভিন্ন বয়স-সীমার দাবি আন্দোলনরতদের।)
• কোটায় কোনও ধরনের বিশেষ পরীক্ষা নেয়া যাবে না ( কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষার্থীরা চাকরি আবেদনই করতে পারেন না কেবল কোটায় অন্তর্ভুক্তরা পারে)
• চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় একাধিকবার কোটার সুবিধা ব্যবহার করা যাবে না।
বাংলাদেশে প্রচলিত কোটা ব্যবস্থা নিয়ে সমালোচনা শুধু শিক্ষার্থী বা চাকরি-প্রার্থীদের মাঝেই রয়েছে তেমনটি নয়, বিশেষজ্ঞদেরও মতামত রয়েছে কোটা সংস্কারের পক্ষে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এক সাক্ষাতকারে সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আকবর আলি খান বলেন, বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত।
সংবিধানের দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলাদেশের সংবিধানের মূলমন্ত্র হলো সকল নাগরিকের জন্য সমান অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করা। তবে সংবিধানের ২৯(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, “প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সরকারি চাকরিতে যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে সমান সুযোগ থাকবে,” এবং “কোনো বিশেষ শ্রেণী বা সম্প্রদায়ের অনুকূলে সংরক্ষণ ব্যবস্থা করা যাবে।”
কোটা ব্যবস্থার পক্ষে মতামত
কোটা ব্যবস্থা সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার একটি উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখনও অনেক মানুষ শিক্ষা ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে। কোটা ব্যবস্থা এই শ্রেণীর মানুষদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ দেয়, যা তাদের জীবনমান উন্নতিতে সহায়ক হয়।
*মুক্তিযোদ্ধা কোটা: মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা দেশের জন্য জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছেন, তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য কোটা ব্যবস্থা একটি ন্যায্য দাবি। তারা দেশের স্বাধীনতা অর্জনে বিশেষ অবদান রেখেছেন এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য কিছু সুবিধা দেওয়া উচিত।
*নারী কোটা: নারীরা দীর্ঘদিন ধরে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছেন। নারী কোটা তাদের ক্ষমতায়ন ও সমান সুযোগ প্রদানের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। নারীরা সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করে দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
*উপজাতি কোটা: দেশের বিভিন্ন উপজাতি জনগোষ্ঠী শিক্ষা ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে। তাদের জন্য কোটা ব্যবস্থা তাদের উন্নয়নে সহায়ক হয়। এতে তারা সমাজের মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে এবং দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।
*প্রতিবন্ধী কোটা: প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তবে তারা অনেক ক্ষেত্রে অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত। তাদের জন্য কোটা ব্যবস্থা একটি মানবিক ও ন্যায্য পদক্ষেপ, যা তাদের স্বনির্ভর হতে সহায়ক।
কোটা ব্যবস্থার বিপক্ষে মতামত
কোটা ব্যবস্থা নিয়ে একটি বড় অংশের মানুষ সমালোচনামুখর। তাদের মতে, কোটা ব্যবস্থা মেধার মূল্যায়নে বাধা সৃষ্টি করে এবং এটি অন্যান্য যোগ্য প্রার্থীদের প্রতি অবিচার। তারা বিশ্বাস করে, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতাই প্রধান বিবেচ্য হওয়া উচিত।
কোটা ব্যবস্থা মেধার মূল্যায়নে বাধা সৃষ্টি করে: অনেক সময় কোটা ব্যবস্থার কারণে যোগ্য প্রার্থীরা সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়। এটি মেধার সঠিক মূল্যায়নে বাধা সৃষ্টি করে এবং সরকারি সেক্টরে দক্ষ কর্মী নিয়োগে ব্যাঘাত ঘটায়।
অযাচিত সুবিধা: কোটা ব্যবস্থার ফলে অনেক সময় অযোগ্য প্রার্থীরা সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করে। এটি সরকারি সেক্টরের কর্মদক্ষতা ও কর্মপরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অযাচিত সুবিধা প্রদান করার ফলে মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীরা প্রাপ্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশে নিবর্তনমূলক আটক ও ক্ষমতা অপব্যবহারের ঝুঁকি
কোটা ব্যবস্থার সমাধান
কোটা ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, এটি দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও সাংবিধানিক প্রেক্ষাপট। তাই, কোটা ব্যবস্থার একটি সুষ্ঠু ও ন্যায্য মূল্যায়ন প্রয়োজন। সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কোটা ব্যবস্থা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে এর সঠিক প্রয়োগ এবং মেধার সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
কোটা ব্যবস্থার সঠিক মূল্যায়ন: কোটা ব্যবস্থার সঠিক মূল্যায়ন করে এটি পুনর্গঠন করা উচিত। বিশেষ করে, যেসব ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থার অপব্যবহার হচ্ছে, সেসব ক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
মেধার মূল্যায়ন: কোটা ব্যবস্থা বজায় রেখে মেধার মূল্যায়ন নিশ্চিত করা উচিত। এটি নিশ্চিত করতে হলে, সরকারি চাকরির পরীক্ষা ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।
সামাজিক উন্নয়ন: কোটা ব্যবস্থার পাশাপাশি, সমাজের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। এতে তারা মেধার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হবে।
উপসংহার
বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা একটি সংবেদনশীল ও বিতর্কিত বিষয়। সংবিধান ও মানুষের মতামতের ভিত্তিতে এটি স্পষ্ট যে, কোটা ব্যবস্থার একটি সুষ্ঠু ও ন্যায্য মূল্যায়ন প্রয়োজন। সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কোটা ব্যবস্থা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে এর সঠিক প্রয়োগ এবং মেধার সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্লগের মাধ্যমে, কোটা ব্যবস্থা নিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে, যা সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য সুবিচার নিশ্চিত করবে।
বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও সাংবিধানিক প্রেক্ষাপট, যা দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর সঠিক প্রয়োগ ও মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হলে, সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের মতামত ও সহযোগিতা প্রয়োজন। শুধুমাত্র তাত্ত্বিক নয়, বাস্তবিকভাবে কোটা ব্যবস্থা সমাজের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
[…] […]
[…] […]
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি যৌক্তিক নয়।
I truly appreciate your technique of writing a blog. I added it to my bookmark site list and will