সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী

ব্লগ: ময়নুল ইসলাম শাহ্‌


ষোড়শ সংশোধনীর পটভূমি

১৯৭২ সালের বাংলাদেশের সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনীতে তা রাষ্ট্রপতির হাতে স্থানান্তরিত হয়। পরে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হয়, যার মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয় কাউন্সিলকে।
তবে ২০১৪ সালে পাস হওয়া ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা আবারও সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়, যা পরবর্তীতে আইনি বিতর্কের সৃষ্টি করে।

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল: আইনি প্রেক্ষাপট

২০১৬ সালে হাইকোর্ট ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে। আদালত যুক্তি দেয় যে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়তে পারে যদি বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকে। এর বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে আপিল করা হলেও আপিল বিভাগ সর্বসম্মতভাবে রায় দেয় যে, ষোড়শ সংশোধনী অসাংবিধানিক এবং এটি বাতিল থাকবে। এর ফলে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা তাদের কাছে ফিরে যায়।

বহুল আলোচিত ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে, দেশের গণতন্ত্র, রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, সুশাসন, দুর্নীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে। তবে আপিল বিভাগের দেয়া সে রায় রিভিউ চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় রাষ্ট্রপক্ষ ৯০৮ পৃষ্ঠার এ রিভিউ আবেদনে ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে ৯৪টি যুক্তি দেখিয়ে আপিল বিভাগের রায় বাতিল চাওয়া হয়েছিল।

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের প্রভাব

এই রায়ের ফলে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে এবং বিচারকদের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব কমবে। বিচার বিভাগের উপর অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ হবে এতে। রাজনৈতিক দলগুলো বিচার বিভাগের উপর স্বৈরাচারমূলক নিয়ন্ত্রণ করতে আর পারবে না।

সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের গুরুত্ব

সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল বিচার বিভাগের ভেতরে একটি সংরক্ষিত প্রক্রিয়া যা বিচারকদের অপসারণে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করে। এটি বিচার বিভাগের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। এর অধীনে বিচারকদের জবাবদিহিতা আগের চেয়ে আরও বেশী নিশ্চিত করা যাবে। বিচারকদের মধ্যে সমমানসিকতা ও আন্তসমন্বয় বৃদ্ধি পাবে।

নতুন রায়: পর্যালোচনা

২০২৪ সালের ২০ অক্টোবর আপিল বিভাগ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনঃপর্যালোচনা করে। রায়ের পর সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের ক্ষমতা পুনর্বহাল হওয়ায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হলো। এটি বাংলাদেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।


এফএকিউ (FAQs)

১. ষোড়শ সংশোধনী কী?
ষোড়শ সংশোধনী বাংলাদেশ সংবিধানের একটি পরিবর্তন, যা বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিল।

২. সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল কী?
সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল বিচারপতিদের অপসারণে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি, যা উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের প্রক্রিয়া পরিচালনা করে।

৩. ষোড়শ সংশোধনী কেন বাতিল করা হলো?
ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করা হয় কারণ এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর হুমকি সৃষ্টি করেছিল এবং রাজনৈতিক প্রভাব বাড়াতে পারত।

৪. সুপ্রিম কোর্টের রিভিউ আবেদন কী?
রিভিউ আবেদন হলো একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট পূর্বের রায় পুনর্বিবেচনা করে নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।

৫. ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের ফলে কী ঘটেছে?
ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ার ফলে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা আবার সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে ফিরে এসেছে।

৬. সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের দায়িত্ব কী?
সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের দায়িত্ব হলো বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষেত্রে তদন্ত পরিচালনা করা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।

৭. সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী কী?
সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী ১৯৭৫ সালে পাস হয়, যার মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে দেওয়া হয়।

৮. ২০১৪ সালে ষোড়শ সংশোধনী কেন আনা হয়েছিল?
২০১৪ সালে বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনার জন্য ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়।

৯. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা একটি রাষ্ট্রের আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকে।

১০. রিভিউ আবেদনের ফলাফল কী?
রিভিউ আবেদনের ফলে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং ষোড়শ সংশোধনী বাতিলই বহাল থাকে।

১১. বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি কী?
বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে সংবিধান সংশোধনের সুনির্দিষ্ট নিয়ম বা পদ্ধতি উল্লেখিত রয়েছে। সে অনুযায়ী জাতীয় সংসদকেই এর উদ্যোগ নিতে হয়। সংসদের মোট সদস্যসংখ্যার কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে সংশোধনী প্রস্তাব গৃহীত হতে হয়।


One thought on “সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী: বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা ও আইনি বিতর্ক”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।