শব্দ দূষণ ও তার প্রতিকার বিষয়ক আইনশব্দ দূষণ ও তার প্রতিকার

শব্দ দূষণের কারণ, প্রতিকার, প্রভাব, আইন, রচনা অণুচ্ছেদ ও শব্দ দূষণ বিধিমালা ২০০৬

লেখাঃ ময়নুল ইসলাম শাহ্‌

ভূমিকা

আধুনিক নগর জীবনে এটি একটি বড় সমস্যা। এটি শুধু পরিবেশের ক্ষতি করে না, বরং মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকার ২০০৬ সালে শব্দ দূষণ বিধিমালা প্রণয়ন করে। এই ব্লগে আমরা শব্দ দূষণের কারণ, প্রভাব, আইনি পদক্ষেপ, এবং প্রতিকারের উপায় নিয়ে আলোচনা করবো।


শব্দ দূষণ কী?

এটি এমন একটি পরিস্থিতি যেখানে পরিবেশে অবাঞ্ছিত এবং অতিরিক্ত শব্দের কারণে মানুষ ও প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি সাধারণত ৭০ ডেসিবেলের উপরে হলে ক্ষতিকর বলে গণ্য হয়।

শব্দ দূষণের ধরন

  1. পরিবেশগত শব্দ দূষণ: যানবাহন, শিল্প কারখানা, নির্মাণকাজ ইত্যাদির শব্দ।
  2. সামাজিক শব্দ দূষণ: সামাজিক অনুষ্ঠান, উচ্চস্বরে মাইক বা ডিভাইস ব্যবহার।

বাংলাদেশের শব্দ দূষণ বিধিমালা ২০০৬

২০০৬ সালের শব্দ দূষণ বিধিমালা অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন এলাকাকে পাঁচটি জোনে ভাগ করা হয়েছে:

  1. নীরব এলাকা: হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
  2. আবাসিক এলাকা: বসবাসের জন্য নির্ধারিত অঞ্চল।
  3. বাণিজ্যিক এলাকা: অফিস ও দোকানপাট এলাকা।
  4. শিল্প এলাকা: কারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত অঞ্চল।
  5. মিশ্র এলাকা: উপরের সব ধরনের কার্যক্রমের মিশ্রণ।

প্রত্যেক এলাকার জন্য আলাদা শব্দসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।

নির্ধারিত শব্দসীমা:

  • নীরব এলাকা: দিনে ৫০ ডেসিবেল, রাতে ৪০ ডেসিবেল।
  • আবাসিক এলাকা: দিনে ৫৫ ডেসিবেল, রাতে ৪৫ ডেসিবেল।
  • বাণিজ্যিক এলাকা: দিনে ৭০ ডেসিবেল, রাতে ৬০ ডেসিবেল।
  • শিল্প এলাকা: দিনে ৭৫ ডেসিবেল, রাতে ৭০ ডেসিবেল।

শব্দ দূষণের জন্য অভিযোগ করার নিয়ম

শব্দ দূষণের শিকার হলে নিম্নোক্ত ধাপে অভিযোগ জানানো যেতে পারে:

  1. প্রথম ধাপ: স্থানীয় প্রশাসন (ইউনিয়ন পরিষদ বা সিটি কর্পোরেশন) বরাবর অভিযোগ করা।
  2. দ্বিতীয় ধাপ: পরিবেশ অধিদপ্তরের স্থানীয় কার্যালয়ে অভিযোগ জমা দেওয়া।
  3. তৃতীয় ধাপ: আইন প্রয়োগকারী সংস্থার (পুলিশ) কাছে অভিযোগ করা।

শব্দ দূষণ বন্ধের জন্য কোথায় অভিযোগ করবো?

শব্দ দূষণের অভিযোগ করতে পারেন:

  • পরিবেশ অধিদপ্তর: [DOE অফিসের ঠিকানা ও হটলাইন নম্বর ব্যবহার করুন]।
  • স্থানীয় প্রশাসন: উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়।
  • আইন প্রয়োগকারী সংস্থা: পুলিশের হেল্পলাইন বা ট্রাফিক বিভাগ।

শব্দ দূষণ নিয়ে অভিযোগ দরখাস্তের পূর্ণাঙ্গ নমুনা

তারিখ: [অভিযোগ করার তারিখ]
প্রাপক: [পরিবেশ অধিদপ্তর/স্থানীয় প্রশাসনের নাম]

বিষয়: শব্দ দূষণের প্রতিকার চেয়ে আবেদন।

মাননীয় মহোদয়,
আমাদের এলাকার [স্থান বা উৎসের নাম] থেকে অতিরিক্ত শব্দ দূষণ হচ্ছে, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে। অনুগ্রহপূর্বক বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করছি।

সাথে সংযুক্তি:

  1. শব্দ দূষণের ভিডিও/ছবি।
  2. এলাকার নাম ও উৎস।

আপনার বিশ্বস্ত,
[আপনার নাম ও ঠিকানা]


শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ এবং শব্দ দূষণ বিধিমালা, ২০০৬ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা যদি নির্ধারিত শব্দসীমা অতিক্রম করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।


শব্দ দূষণ প্রজেক্ট

পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বিভিন্ন এনজিও’র যৌথ উদ্যোগে ‘শব্দ দূষণ প্রজেক্ট’ পরিচালিত হচ্ছে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য হল:

  1. জনসচেতনতা বৃদ্ধি।
  2. শহরাঞ্চলে শব্দসীমা নির্ধারণ ও এর বাস্তবায়ন।
  3. আইন প্রয়োগে স্থানীয় প্রশাসনকে সক্ষম করা।

শব্দ দূষণের ১০টি প্রধান কারণ

  1. যানবাহনের উচ্চশব্দ।
  2. নির্মাণকাজ।
  3. শিল্প কারখানার যন্ত্রপাতি।
  4. সামাজিক অনুষ্ঠানের উচ্চস্বরে গান বা মাইক।
  5. বাজার ও বাণিজ্যিক এলাকার কোলাহল।
  6. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এলাকায় মাইকিং।
  7. বিমানবন্দর ও রেলস্টেশনের শব্দ।
  8. গৃহস্থালির যন্ত্রপাতি।
  9. রাস্তার পশুপাখির চিৎকার।
  10. উচ্চশব্দে গেমিং বা বিনোদন।

শব্দ দূষণের মাত্রা কত ডেসিবেল?

  • নীরবতা: ২০-৩০ ডেসিবেল।
  • মানুষের কথোপকথন: ৬০ ডেসিবেল।
  • যানবাহনের শব্দ: ৮০-১০০ ডেসিবেল।
  • অত্যন্ত ক্ষতিকর শব্দ: ১২০ ডেসিবেলের উপরে।

দূষণ বন্ধে স্লোগান

  1. স্লোগান- “শব্দ নয়, শান্তি চাই।”
  2. “শব্দ দূষণ, স্বাস্থ্যহানি।”
  3. “শব্দ কমান, পরিবেশ বাঁচান।”
  4. “শান্তি চাই? শব্দ কমান।”
  5. “উচ্চশব্দ নয়, সুস্থ জীবন চাই।”

শব্দ দূষণের প্রতিকার

  1. আইন বাস্তবায়ন জোরদার করা।
  2. জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।
  3. শব্দপ্রতিরোধী যন্ত্রপাতি ব্যবহার।
  4. উচ্চশব্দে মাইক বা স্পিকার ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ।
  5. পরিবেশ বান্ধব যানবাহন প্রচলন।
  6. নিয়মিত মনিটরিং ও জরিমানা।

শব্দ দূষণ ও তার প্রতিকার বিষয়ক আইন
শব্দ দূষণ ও তার প্রতিকার

এফএকিউ

  1. প্রশ্ন: শব্দ দূষণ কীভাবে স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে?
    উত্তর: এটি শ্রবণশক্তি হ্রাস, উচ্চ রক্তচাপ, এবং মানসিক চাপ সৃষ্টি করে।
  2. প্রশ্ন: শব্দ দূষণ কোথায় বেশি হয়?
    উত্তর: শহরাঞ্চল, বাজার ও শিল্প এলাকায়।
  3. প্রশ্ন: শব্দ দূষণ কমানোর প্রযুক্তি কী কী?
    উত্তর: শব্দনিরোধক যন্ত্রপাতি ও সাইলেন্সার।
  4. প্রশ্ন: বাংলাদেশে শব্দ দূষণ আইনের প্রয়োগ কীভাবে হয়?
    উত্তর: পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন দ্বারা।
  5. প্রশ্ন: শব্দ দূষণ থেকে বাচ্চাদের রক্ষা করার উপায় কী?
    উত্তর: নীরব পরিবেশে থাকা এবং কানে হেডফোন কম ব্যবহার করা।
  6. প্রশ্ন: শব্দ দূষণ কি অপরাধ?
    উত্তর: হ্যাঁ, বাংলাদেশে এটি আইনত দণ্ডনীয়।
  7. প্রশ্ন: শব্দ দূষণের প্রতিকার কীভাবে সম্ভব?
    উত্তর: জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে।
  8. প্রশ্ন: শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সফল দেশ কোনটি?
    উত্তর: জাপান ও সুইডেন।
  9. প্রশ্ন: উচ্চ শব্দে মাইক ব্যবহারে কি জরিমানা হয়?
    উত্তর: হ্যাঁ, নির্ধারিত জরিমানা ও শাস্তি আছে।
  10. প্রশ্ন: কোন এলাকায় শব্দ দূষণ বেশি হয়?
    উত্তর: বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকায়।
  11. প্রশ্ন: শব্দ দূষণের আইনি শাস্তি কী?
    উত্তর: জরিমানা বা কারাদণ্ড।
  12. প্রশ্ন: শব্দ দূষণের প্রতিকার কে করবে?
  13. উত্তর: পরিবেশ অধিদপ্তর এবং স্থানীয় প্রশাসন।
  14. প্রশ্ন: শব্দ দূষণ নিয়ে কাজ করে এমন এনজিও?
    উত্তর: পরিবেশবান্ধব সংস্থা।
  15. প্রশ্ন: শব্দ দূষণ কি শুধুমাত্র শহরে হয়?
    উত্তর: না, গ্রামেও এটি হতে পারে।
  16. প্রশ্ন: শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির ভূমিকা কী?
    উত্তর: অত্যাধুনিক সাইলেন্সার এবং শব্দ রেকর্ডিং যন্ত্র।

উপসংহার
শব্দ দূষণ একটি গুরুতর পরিবেশগত সমস্যা। এটি নিয়ন্ত্রণে আমাদের সচেতনতা ও সরকারের আইনি প্রয়াস প্রয়োজন। নিজে সচেতন হোন এবং অন্যকেও সচেতন করুন।


আপনার মতামতই ও ফিডব্যাক দিন।

আরও পড়ুন- জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ সংক্রান্ত আইন—বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যত

বাংলাদেশ সংবিধানঃ নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার—একটি নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ

শব্দ দূষণ রোধে কী বলছে আইন!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।