Preventive Detention Laws in Bangladesh By Moynul Islam Shah
নিবর্তনমূলক আটক অবশ্যই শাস্তিমূলক আটক বা গ্রেফতার থেকে ভিন্নতর। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক কাঠামো ও আইনি ব্যবস্থার মধ্যে নিবর্তনমূলক আটক একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত বিষয়। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের সরকার এই আইনটি পুনরায় কার্যকর করার পর থেকেই এটি সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এই ব্লগে আমরা নিবর্তনমূলক আটক সংক্রান্ত কিছু মূল দিক নিয়ে আলোচনা করব এবং এর প্রভাব ও সম্ভাব্য সমাধানের পথ অনুসন্ধান করব।
নিবর্তনমূলক আটক কি?
নিবর্তনমূলক আটক হলো এমন একটি আইন যেখানে সন্দেহভাজন অপরাধীদের কোনোরকম বিচার ছাড়াই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আটক রাখা হয়। বাংলাদেশে এই আইনটি প্রধানত রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার উদ্দেশ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে, এই আইনের অপব্যবহার নিয়ে প্রচুর সমালোচনা রয়েছে।
সংবিধানের প্রাসঙ্গিক অনুচ্ছেদ
অনুচ্ছেদ ৩৩: ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অনুচ্ছেদ ৩৩-এ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার অধিকার সুরক্ষিত করা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “কোনো ব্যক্তিকে আটক করা হলে তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে এবং তার আটকসংক্রান্ত কারণ জানাতে হবে।” এ ধারায় আরও বলা হয়েছে, “বিচারবিহীন আটক আইনসংগত নয়।”
অনুচ্ছেদ ৩৫: বিচার ও শাস্তি অনুচ্ছেদ ৩৫-এ বিচার ও শাস্তির ন্যায়সংগত প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে, “কোনো ব্যক্তি যেন নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য না হন এবং তাকে ন্যায়সঙ্গত বিচার পাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে।”
অনুচ্ছেদ ৩৬: চলাফেরার স্বাধীনতা অনুচ্ছেদ ৩৬-এ বাংলাদেশের মধ্যে যেকোনো স্থানে চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, “প্রত্যেক নাগরিকের বাংলাদেশের মধ্যে মুক্তভাবে চলাফেরা করার অধিকার থাকবে।”
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান
মৌলিক অধিকার
গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ
৩৩।1[ (১) গ্রেপ্তারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁহার দ্বারা আত্মপক্ষ-সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না।
(২) গ্রেপ্তারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেপ্তারের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে (গ্রেপ্তারের স্থান হইতে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আনয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যতিরেকে) হাজির করা হইবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাঁহাকে তদতিরিক্তকাল প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না।
(৩) এই অনুচ্ছেদের (১) ও (২) দফার কোন কিছুই সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হইবে না,
(ক) যিনি বর্তমান সময়ের জন্য বিদেশী শত্রু; অথবা
(খ) যাঁহাকে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান-সংবলিত কোন আইনের অধীন গ্রেপ্তার করা হইয়াছে বা আটক করা হইয়াছে।
(৪) নিবর্তনমূলক আটকের বিধান-সংবলিত কোন আইন কোন ব্যক্তিকে ছয় মাসের অধিক কাল আটক রাখিবার ক্ষমতা প্রদান করিবে না যদি সুপ্রীম কোর্টের বিচারক রহিয়াছেন বা ছিলেন কিংবা সুপ্রীম কোর্টের বিচারকপদে নিয়োগলাভের যোগ্যতা রাখেন, এইরূপ দুইজন এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত একজন প্রবীণ কর্মচারীর সমন্বয়ে গঠিত কোন উপদেষ্টা-পর্ষদ্ উক্ত ছয় মাস অতিবাহিত হইবার পূর্বে তাঁহাকে উপস্থিত হইয়া বক্তব্য পেশ করিবার সুযোগদানের পর রিপোর্ট প্রদান না করিয়া থাকেন যে, পর্ষদের মতে উক্ত ব্যক্তিকে তদতিরিক্ত কাল আটক রাখিবার পর্যাপ্ত কারণ রহিয়াছে।
(৫) নিবর্তনমূলক আটকের বিধান-সংবলিত কোন আইনের অধীন প্রদত্ত আদেশ অনুযায়ী কোন ব্যক্তিকে আটক করা হইলে আদেশদানকারী কর্তৃপক্ষ তাঁহাকে যথাসম্ভব শীঘ্র আদেশদানের কারণ জ্ঞাপন করিবেন এবং উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে বক্তব্য-প্রকাশের জন্য তাঁহাকে যত সত্বর সম্ভব সুযোগদান করিবেন:
তবে শর্ত থাকে যে, আদেশদানকারী কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় তথ্যাদি-প্রকাশ জনস্বার্থবিরোধী বলিয়া মনে হইলে অনুরূপ কর্তৃপক্ষ তাহা প্রকাশে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করিতে পারিবেন।
(৬) উপদেষ্টা-পর্ষদ কর্তৃক এই অনুচ্ছেদের (৪) দফার অধীন তদন্তের জন্য অনুসরণীয় পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নির্ধারণ করিতে পারিবেন।] http://bdlaws.minlaw.gov.bd/act-957/section-29999.html
নিবর্তনমূলক আটক ও সংবিধান
সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্য
নিবর্তনমূলক আটক আইনটি বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত ধারার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশেষ করে, অনুচ্ছেদ ৩৩ ও ৩৫-এর অধীনে প্রদত্ত ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের অধিকারকে লঙ্ঘন করে। বিচারবিহীন আটকের মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হরণ করা হলে তা সংবিধানের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে।
আইনি চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টে নিবর্তনমূলক আটক আইন নিয়ে বিভিন্ন মামলা দায়ের করা হয়েছে। আদালতগুলো বিভিন্ন সময়ে এই আইনের অপব্যবহার সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়েছে এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিভিন্ন রায় প্রদান করেছে।
প্রাসঙ্গিক সংশোধনী
সংবিধানের আলোকে নিবর্তনমূলক আটক আইন সংশোধন করা প্রয়োজন। এই সংশোধনীতে ন্যায়বিচার ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সুরক্ষিত রাখতে হবে এবং বিচার প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে হবে।
আইনের অপব্যবহার ও মানবাধিকার লঙ্ঘন
নিবর্তনমূলক আটক ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিরোধীদের হয়রানি করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই আইনের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে বারবার আওয়াজ তুলেছে। বিচারবিহীন আটক, নির্যাতন এবং মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন এখানকার অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।
আইনি কাঠামো ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা
নিবর্তনমূলক আটক প্রক্রিয়ায় আইনি সুরক্ষা নেই বলে সমালোচকদের দাবি। আটককৃত ব্যক্তিরা বিচার পাওয়ার সুযোগ পান না, যা একটি গণতান্ত্রিক দেশের জন্য বড় প্রশ্ন তুলেছে। এছাড়াও, প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে যা এই আইনের অপব্যবহারকে উৎসাহিত করে।
সমাধানের পথ বা আইনগত রক্ষাকবচঃ
নিবর্তনমূলক আটক সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানে নিম্নলিখিত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:
- আইনি সংস্কার: নিবর্তনমূলক আটক আইন সংশোধন করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
- বিচারিক ব্যবস্থা: আটককৃত ব্যক্তিদের দ্রুত বিচার প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা এবং তাদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা।
- মানবাধিকার সংস্থার ভূমিকা: মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সক্রিয়তা বৃদ্ধি এবং তাদের পরামর্শ অনুযায়ী আইন বাস্তবায়ন করা।
- সচেতনতা বৃদ্ধি: জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং গণমাধ্যমের মাধ্যমে নিবর্তনমূলক আটকের বিরোধী প্রচার চালানো।
উপসংহার
বাংলাদেশ সংবিধান ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে। তবে, নিবর্তনমূলক আটক আইন সংবিধানের এই মৌলিক অধিকারগুলো লঙ্ঘন করে। সংবিধানের আলোকে এই আইনটির পুনর্বিবেচনা ও সংশোধন করা প্রয়োজন, যাতে দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত থাকে এবং আইনি প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও ন্যায়সংগত হয়। সংবিধানের মৌলিক আদর্শ ও নীতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে একটি ন্যায়সঙ্গত ও মানবিক সমাজ গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
আরও পড়ুন ভূমি আইন ২০২৩ দখল সংক্রান্ত অপরাধ ও প্রতিকার https://moynulshah.com/%e0%a6%ad%e0%a7%82%e0%a6%ae%e0%a6%bf-%e0%a6%86%e0%a6%87%e0%a6%a8-%e0%a7%a8%e0%a7%a6%e0%a7%a8%e0%a7%a9-%e0%a6%a6%e0%a6%96%e0%a6%b2-%e0%a6%b8%e0%a6%82%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%a8/#comment-24
[…] […]
[…] […]
নিবর্তন আটক সীমিত করা উচিৎ।