ভূমিকা
বাংলাদেশের সংবিধান দেশের গণতান্ত্রিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি নির্ধারণ করে। ১৯৭২ সালে প্রণীত এই সংবিধানে বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত একটি হলো পঞ্চদশ সংশোধনী। ২০১১ সালে পাসকৃত এই সংশোধনী রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলে এবং এটি নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক ও আলোচনার ঝড় ওঠে। এই ব্লগে পঞ্চদশ সংশোধনীর মূল বিষয়বস্তু, এর পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি এবং এর রাজনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মূল বিষয়বস্তু
২০১১ সালের ৩০ জুন সংসদে পাস হওয়া পঞ্চদশ সংশোধনীটি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনে, যার মধ্যে অন্যতম হলো:
- তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তি: এই সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৯৬ সালে সংবিধানে যুক্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করা হয়। এর আগে প্রতিটি সাধারণ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতো, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা।
- ধর্মনিরপেক্ষতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা: সংবিধানের মূল নীতিগুলির মধ্যে অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষতা, যা ১৯৭৫ সালে বাতিল করা হয়েছিল, তা পুনরায় সংবিধানে সংযোজন করা হয়। এই পরিবর্তনের ফলে ধর্মের ভিত্তিতে কোনো বৈষম্য করা যাবে না বলে আবারও স্পষ্ট করা হয়।
- জাতীয় চার মূলনীতি পুনর্বহাল: এই সংশোধনীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে ওঠা গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, এবং জাতীয়তাবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
- সংবিধানের কিছু ধারা অপরিবর্তনীয় ঘোষণা: সংবিধানের কিছু মৌলিক বিষয়কে অপরিবর্তনীয় ঘোষণা করা হয়েছে, যেমন স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, এবং গণতন্ত্রের নীতি। ভবিষ্যতে কোনো সরকার এই বিষয়গুলিকে পরিবর্তন করতে পারবে না।
পঞ্চদশ সংশোধনীর পক্ষে যুক্তি
- নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য সংবিধানের পরিবর্তন: তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করার যুক্তি হিসেবে বলা হয়, এই ব্যবস্থা সংবিধানের মূল নীতির বিরুদ্ধে যায়। ২০০৭-২০০৮ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অপব্যবহার এবং দীর্ঘায়িত শাসনকে কেন্দ্র করে এর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তাই একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচিত সরকারই সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারে বলে দাবি করা হয়।
- ধর্মনিরপেক্ষতা পুনর্বহাল: পঞ্চদশ সংশোধনীতে ধর্মনিরপেক্ষতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় চার মূলনীতির পুনর্বহাল একটি বড় ধাপ ছিল। এটি দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধার এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে দাবি করা হয়।
- মৌলিক নীতিমালা অপরিবর্তনীয় করা: দেশের সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতার বিষয়গুলি অপরিবর্তনীয় ঘোষণা করার মাধ্যমে সংবিধানের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়।
পঞ্চদশ সংশোধনীর বিপক্ষে যুক্তি
- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলুপ্তি নিয়ে বিতর্ক: বিরোধী দলগুলোর মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য ছিল। তাদের দাবি, ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন করলে সরকারি সুবিধা গ্রহণ এবং অনিয়মের সম্ভাবনা থাকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তি করে সরকার ক্ষমতার অপব্যবহারের পথ তৈরি করেছে বলে অভিযোগ করা হয়।
- সংবিধানের কিছু ধারাকে অপরিবর্তনীয় ঘোষণা করা: বিরোধী দল এবং কিছু সংবিধান বিশেষজ্ঞের মতে, সংবিধানের কিছু ধারা অপরিবর্তনীয় ঘোষণা করা সাংবিধানিকভাবে বিতর্কিত হতে পারে। ভবিষ্যতে পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে এই ধারা পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না, যা দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
- ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ: কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠী এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, কারণ তারা মনে করে ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রধর্মের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হওয়ায়, রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের গুরুত্ব অগ্রাহ্য করা হয়েছে বলে তাদের দাবি।
পঞ্চদশ সংশোধনী আইন কি?
সংবিধান আইন ২০১১ (পঞ্চদশ সংশোধনী) পাস হয় ২০১১ সালের ৩০শে জুন এবং রাষ্ট্রপতির অনুমোদন হয় ২০১১ সালের ৩রা জুলাই। এই সংশোধনী দ্বারা সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল করা হয় এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয়।
রাজনৈতিক প্রভাব
পঞ্চদশ সংশোধনী দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে। এই সংশোধনীর পর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তি নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ব্যাপক রাজনৈতিক উত্তেজনা দেখা দেয়। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি এবং এর মিত্ররা, যার ফলে আওয়ামী লীগ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে। এর ফলে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে যায়।
উপসংহার
পঞ্চদশ সংশোধনী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা দেশের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছে। যদিও সংশোধনীটি দেশকে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে বলে দাবি করা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তি নিয়ে বিতর্ক এখনো থেমে নেই।
Moynul Islam Shah
[…] […]
[…] […]