রাজনৈতিক বাণিজ্য ও সরকারের উপর ব্যবসায়ী নেতাদের দাপট । লেখকঃ ময়নুল ইসলাম শাহ্
পলিটিক্যাল বিজনেস (Political Business) বা রাজনৈতিক বাণিজ্য একটি জটিল ও বহুমুখী বিষয় যা রাজনীতির উপর ব্যক্তিবিশেষের প্রভাব ও ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তসমূহে ব্যবসায়ী নেতাদের একচ্ছত্র দাপুটে স্বভাবকে বোঝায়। বিষয়টি বোঝার জন্য আমাদের ব্যবসায় ও রাজনীতির মধ্যে সম্পর্কগুলো কীভাবে স্বার্থদ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়, তার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
পলিটিক্যাল বিজনেস বা রাজনৈতিক বাণিজ্য কি?
পলিটিক্যাল বিজনেস বলতে বোঝায় সেই প্রক্রিয়া বা কার্যক্রম যা ব্যবসায়িক সংস্থাগুলি রাজনৈতিক শক্তির উপর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে তাদের অন্যায্য কার্যক্রম পরিচালনা ও মুনাফা বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন, লবিং, রাজনৈতিক অনুদান সর্বোপরি স্বার্থ হাসিল করাসহ অন্যান্য কার্যক্রমের মাধ্যমে সম্পন্ন করে।
পলিটিক্যাল বিজনেসের প্রভাব
১. নীতিমালা প্রণয়ন ও পরিবর্তন
ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি প্রায়শই তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে সরকারি নীতিমালা প্রণয়নে প্রভাব ফেলে। এটি করা হয় লবিং এবং রাজনৈতিক অনুদানের মাধ্যমে। উদাহরণস্বরূপ, পরিবেশ বান্ধব আইন শিথিল করতে তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলি সরকারে সাথে লবিং করে এবং বাধ্য করে।
২. প্রতিযোগিতা
রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহারের মাধ্যমে কিছু কোম্পানি বাজারে প্রতিযোগিতার সামর্থ্য বাড়ায়। এটি বাজারে নতুন প্রবেশকারীদের জন্য বাধা সৃষ্টি করে এবং বিদ্যমান কোম্পানিগুলি নিজেদের জন্য একটি সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করে, অর্থাৎ, বাজারে প্রতিযোগিতার পরিবর্তে একচেটিয়া কারবার পরিচালনা করে।
৩. ভর্তুকি ও কর সুবিধা
কিছু কোম্পানি রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে সরকার থেকে ভর্তুকি ও কর সুবিধা আদায় করে নেয়। এটি তাদের পরিচালন ব্যয় হ্রাস করে এবং মুনাফার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ত্বয়াণ্বিত করে।
৪. আন্তর্জাতিক বাণিজ্য
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু কোম্পানি সরকারের উপর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আমদানী-রপ্তানীর একচেটিয়া বাণিজ্যের পরিবেশ সৃষ্টি করে। বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্য চুক্তি প্রণয়ন ও রপ্তানি-আমদানি শুল্ক নির্ধারণে রাজনৈতিক প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পলিটিক্যাল বিজনেসের উপাদানসমূহ
১. লবিং
লবিং হলো সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ব্যবসায়িক সংস্থাগুলি নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করে। লবিং করা হয় বিশেষজ্ঞ লবিস্ট বা সংস্থার মাধ্যমে।
2. রাজনৈতিক অনুদান
ব্যবসায়িক সংস্থাগুলি প্রায়ই রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী প্রচারণা বা অন্যান্য রাজনৈতিক কার্যক্রমে আর্থিক অনুদান বা সাহায্য প্রদান করে। সেই রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গেলে পূর্ববর্তী আর্থিক সম্পর্কের জের ধরে তাদের অর্থনৈতিক শোষণের ক্ষেত্রকে মজবুত করে।
3. নিয়ন্ত্রক ক্যাপচার
নিয়ন্ত্রক ক্যাপচার হল সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সরকারী নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলি ব্যবসায়িক সংস্থার প্রভাবাধীন হয়ে যায় এবং নির্দিষ্ট সংস্থার স্বার্থ রক্ষা করে।
4. ব্যবসায়িক সংস্থা ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে সম্পর্ক
ব্যবসায়িক সংস্থাগুলি প্রায়শই রাজনৈতিক দলগুলির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে, যা সিন্ডিকেট তৈরির মাধ্যমে তাদের বাজারভিত্তিক প্রভাব বিস্তারের একটি মাধ্যম।
পলিটিক্যাল বিজনেসের সুবিধা
১. ব্যবসায়িক সুবিধা বৃদ্ধি করা
রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে ব্যবসায়িক সংস্থাগুলি তাদের লাভ বৃদ্ধি করতে পারে। এটি তাদের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা বাড়ায় এবং বাজারে টিকে থাকতে সাহায্য করে।
২. সরকারী নীতিমালা তৈরিতে প্রভাব বিস্তার
ব্যবসায়িক সংস্থাগুলি তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে নীতিমালা প্রণয়নে প্রভাব ফেলতে পারে। এটি তাদের কার্যক্রম সহজ করে তোলে। যদিও এতে শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ কদাচিৎ রক্ষিত হয়।
৩. বাজারের প্রশারিত করা
রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে ব্যবসায়িক সংস্থাগুলি নতুন বাজারে প্রবেশ করতে পারে এবং সেখানে তাদের কার্যক্রম প্রসারিত করতে পারে।
পলিটিক্যাল বিজনেসের অসুবিধা
১. নৈতিক ও আইনগত সমস্যা
পলিটিক্যাল বিজনেস প্রায়শই নৈতিক ও আইনগত সমস্যা সৃষ্টি করে। এটি দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার বৃদ্ধি করতে পারে।
২. প্রতিযোগিতার অবনতির সম্ভাবনা
রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে কিছু কোম্পানি বাজারে প্রতিযোগিতার সামর্থ্য বাড়ায়, যা নতুন প্রবেশকারীদের জন্য বাধা সৃষ্টি করে।
৩. অর্থনৈতিক অস্থিরতা
পলিটিক্যাল বিজনেস প্রায়শই অর্থনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। এটি ব্যবসায়িক সংস্থাগুলির জন্য ঝুঁকি বৃদ্ধি করে এবং বাজারে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে। দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পেছনেও এই বষয়টি দায়ী।
বাস্তব উদাহরণ
১. বড় কোম্পানির লবিং
যুক্তরাষ্ট্রের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলি লবিংয়ের মাধ্যমে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে প্রভাব ফেলে। তারা সরকারি নীতিমালা প্রণয়ন ও পরিবর্তনে কতৃত্বমূলক ভূমিকা পালন করে।
২. রাজনৈতিক অনুদান
ভারতে অনেক বড় ব্যবসায়িক সংস্থা রাজনৈতিক দলগুলিকে নির্বাচনী প্রচারণায় আর্থিক অনুদান প্রদান করে। পরবর্তীতে এটি তাদের ব্যবসায়িক সুবিধা নিশ্চিত করে।
পলিটিক্যাল বিজনেসের নেতিবাচক দিক
পলিটিক্যাল বিজনেস অর্থাৎ ব্যবসা ও রাজনীতির মধ্যে সরাসরি সংযোগ সমাজে বিভিন্ন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে। যদিও এটি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা প্রদান করে, তবে এর নেতিবাচক প্রভাবও উল্লেখযোগ্য। এখানে পলিটিক্যাল বিজনেসের কিছু নেতিবাচক দিক আলোচনা করা হলো।
১. দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার
দুর্নীতির প্রসার
ব্যবসায়িক সংস্থাগুলি রাজনৈতিক দলের সাথে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে প্রায়শই দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। লবিং, রাজনৈতিক অনুদান, এবং অন্যান্য প্রভাবশালী পদ্ধতির মাধ্যমে নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা দুর্নীতিকে প্রণোদিত করে।
স্বার্থপরতার প্রভাব
রাজনীতিবিদেরা তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে ব্যবসায়িক সংস্থাগুলির সাথে জড়িত হয়ে পড়লে জনগণের স্বার্থ অবহেলিত হয়। এটি জনসাধারণের কল্যাণে প্রতিফলিত নীতি ও প্রকল্পগুলির ক্ষতি করে।
২. উদ্ভাবনের বাধা
প্রতিযোগিতার অভাবে বাজারে উদ্ভাবনের উৎসাহ কমে যায়। নতুন এবং ছোট সংস্থাগুলি বড় সংস্থাগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় বাজারে নতুন পণ্যের প্রশার ও সেবার মান বাধাগ্রস্ত হয়।
৩. অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা
অসম বণ্টন
পলিটিক্যাল বিজনেসের মাধ্যমে সরকারী সুবিধা এবং অর্থ কিছু বিশেষ সংস্থার হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। এটি অর্থনৈতিক সম্পদের অসম বণ্টন সৃষ্টি করে এবং সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি করে।
অর্থনৈতিক সংকট
রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে কিছু সংস্থার সুবিধা পাওয়ার ফলে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। এটি অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে এবং সাধারণ জনগণের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
৪. অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা
খবর পড়ুন- রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের প্রভাব বাড়ছে : এই প্রবণতা দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়।
৪. দ্রব্যমূল্যের আস্বাভাবিক ঊর্ধগতি
রাজনৈতিক প্রভাবের ফলে বাজারে পণ্যদ্রব্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। যার ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যেতে পারে। বিশেষত, দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
নৈতিক অবক্ষয়
পলিটিক্যাল বিজনেস প্রায়শই নৈতিক সমস্যার সৃষ্টি করে। ব্যবসায়িক সংস্থাগুলি এবং রাজনীতিবিদেরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে নৈতিকতার সীমা লঙ্ঘন করে।
জনমত বিপর্যয়
রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে ব্যবসায়িক সংস্থাগুলি তাদের স্বার্থ রক্ষার মাধ্যমে জনগণের আস্থা হারায়। এটি রাজনীতি ও ব্যবসার উপর জনমতের বিপর্যয় ঘটায় এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের বিশ্বাস কমে যায়।
৫. পরিবেশগত সমস্যা
পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব
বড় ব্যবসায়িক সংস্থাগুলি প্রায়শই তাদের শিল্প কার্যক্রমে পরিবেশের ক্ষতি করে। রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে তারা পরিবেশবান্ধব নীতিগুলি শিথিল করে যা পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির অভাব
প্রতিযোগিতার অভাবে বড় সংস্থাগুলি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহারে উদাসীন থাকে। এটি পরিবেশ দূষণ ও পরিবেশগত সংকট সৃষ্টি করে।
পলিটিক্যাল বিজনেস একটি জটিল এবং বহুমুখী প্রক্রিয়া যা ব্যবসায়িক সংস্থা ও রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে সম্পর্ক বোঝায়। এটি ব্যবসায়িক সংস্থাগুলির জন্য কিছু সুবিধা প্রদান করে, তবে এটি নৈতিক ও আইনগত সমস্যাও সৃষ্টি করে। তাই, পলিটিক্যাল বিজনেসের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। এই বিষয়ে সচেতনতা এবং সংশ্লিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন গুরুত্বপূর্ণ।
এটি ছিল পলিটিক্যাল বিজনেস সম্পর্কিত একটি বিস্তারিত বিশ্লেষণ। আশা করি, এটি আপনাদের জন্য সহায়ক হবে। যেকোনো প্রশ্ন বা মতামত জানাতে কমেন্ট করতে ভুলবেন না। ধন্যবাদ!
আরও পড়ুন- বাংলাদেশের নতুন পেনশন স্কিম: বিতর্ক ও প্রতিক্রিয়া
লক্ষ্য করুন– বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের ক্ষমতা ও আধিপত্য ক্রমেই বাড়ছে। স্বাধীনতার আগে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে ব্যবসায়ী সংসদ সদস্য ছিলেন ৪ শতাংশ। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ হার ছিল ১৩ শতাংশ। এরপর ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই হার ছিল ৩৪ শতাংশ। ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮ শতাংশে, ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫১ শতাংশ, এবং ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এটি হয়ে যায় ৬৩ শতাংশ। (পরবর্তী সময়ের ক্ষেত্রে এ সংক্রান্ত তথ্য আপনার জানা থাকলে তা কমেন্ট বক্সে লিখুন, প্লিজ)
Very Nice
[…] আরও পড়ুন- পলিটিক্যাল বিজনেস ও ক্ষমতা অপব্যবহার… […]
[…] আরও পড়ুন- পলিটিক্যাল বিজনেস ও ক্ষমতা অপব্যবহার… […]
[…] আরও পড়ুন- পলিটিক্যাল বিজনেস ও ক্ষমতা অ… […]
[…] […]
Very well presented. Every quote was awesome and thanks for sharing the content. Keep sharing and keep motivating others.