ga348d61e801687a98d663b90288c8a16e7874b2e656893d30f1d32892a0deed12d228e86d57807199f68e4436124c39b_640-908714.jpg

বাংলাদেশে তালাক দেয়ার নিয়ম: একটি ইসলামিক পর্যালোচনা

তালাক, যা ইসলামী আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ হিসেবে পরিচিত, বাংলাদেশের পারিবারিক আইনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তালাক প্রদানের প্রক্রিয়া, নোটিশ প্রদান, তালাক প্রত্যাহার, রেজিস্ট্রেশন ফি এবং অন্যান্য বিষয়গুলি এখানে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে।


ইসলামী নিয়মে তালাক

 ইসলাম ধর্মে আনুষ্ঠানিক বিবাহ বিচ্ছেদকে তালাক বলা হয়। স্বামী সর্বাবস্থায় তালাক দিতে পারেন। স্ত্রী শুধুমাত্র তখনই তালাক দিতে পারবেন, যদি বিয়ের সময় (কাবিননামায়) এর লিখিত অনুমতি দেওয়া হয়। ইসলামে বিবাহ বিচ্ছেদ (তালাক) একটি গুরুতর ও গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। এটি করতে হলে নিম্নোক্ত নিয়মগুলি অনুসরণ করতে হয়:

তালাকের ধরণ:

  • তালাক-এ-আহসান: একবার তালাক প্রদান করা হয় এবং স্ত্রীর ইদ্দত (তিনটি হায়েজ বা মাসিক চক্র) সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত স্বামী পুনরায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে।
  • তালাক-এ-হাসান: প্রতি মাসে একবার করে তিনবার তালাক প্রদান করা হয়।
  • তালাক-এ-বাই’ইন: তালাকের পর পুনরায় বিবাহের জন্য হালালা (অন্য পুরুষের সাথে বিবাহ এবং তালাক) প্রয়োজন।
  • তালাক-এ-মুত্তালাক: একবার তালাক প্রদান করা হয় এবং পুনরায় বিবাহের জন্য পুনঃতালাক বা হালালা প্রয়োজন।

তালাক দেয়ার পূর্বে করণীয় কী?

বোঝাপোড়ার মাধ্যমে সমাধান না হলে রাগ-অভিমান প্রকাশ করার জন্য স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে একত্রে রাতযাপন থেকে বিরত থাকবে। স্ত্রীর ঘুমানোর জায়গা পৃথক করে দেবে। স্ত্রী যদি এতেই সতর্ক হয়ে যায় এবং নিজেকে সংশোধন করে নেয়, তাহলে দাম্পত্য জীবন সুখের হবে।

আল্লাহ বলেন, ‘স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা করো তাদের সদুপদেশ দাও। তারপর তাদের শয্যা বর্জন করো। অতঃপর তাদের সামান্য প্রহার করো। (অর্থাৎ এমনভাবে হালকা প্রহার করবে, যাতে শরীরে কোনো যখম বা আঘাত না হয় এবং মুখে ও লজ্জাস্থানে কখনো প্রহার করবে না। যদি তারা তোমাদের অনুগত হয়, তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো পথ অন্বেষণ কোরো না। (সুরা নিসা, আয়াত : ৩৪)

তালাকের উদ্দেশ্য কী?

তালাক প্রদানের উদ্দেশ্য হল অন্যায়, জুলুম ও শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন, জ্বালাতন ও উৎপীড়ন ইত্যাদি অশান্তি হতে মুক্তি লাভ করা। প্রকৃতপক্ষে ইসলামে তালাক প্রদানের উদ্দেশ্য হলো স্বামী-স্ত্রী দাম্পত্য জীবনে আশান্তীময় পরিস্থিতি থেকে সতর্ক থাকা।

তালাক প্রদানের শর্ত:

  • বিবাহিত সম্পর্কের মধ্যে সমস্যা সমাধানের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে তালাকের চিন্তা করা হয়।
  • তালাক দেওয়ার আগে স্ত্রীর সম্মতি নেওয়া বা অন্তত তাকে অবগত করা উচিত।

তালাকের ঘোষণা:

  • স্বামী বা স্ত্রী উভয়ে তালাকের ঘোষণা দিতে পারেন। এ ঘোষণা মৌখিক বা লিখিত উভয়প্রকার হতে পারে।

তালাকের নোটিশ

বাংলাদেশে তালাক প্রদান করার জন্য সরকারী নিয়ম অনুসরণ করা জরুরি:

তালাকের নোটিশ:

  • স্বামীকে প্রথমে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বা পৌরসভার মেয়রের কাছে একটি লিখিত নোটিশ প্রদান করতে হবে।
  • নোটিশে স্বামী ও স্ত্রীর নাম, ঠিকানা এবং বিবাহের তারিখ উল্লেখ করা হবে।

নোটিশের প্রক্রিয়া:

  • ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভা কর্তৃপক্ষ নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে উভয় পক্ষকে শুনানির জন্য ডাকে।
  • তিনবার শুনানি (৯০ দিনের মধ্যে) করার পরও যদি সমাধান না হয়, তবে তালাক কার্যকর হয়।
  • ৯০ দিনের মধ্যে কোন সমঝোতা না হলে তালাক কার্যকর হয়।
  • সব কটি দফায় প্রথম স্বামী বা স্ত্রী যাকে সেটি পাঠানো হবে, তার ঠিকানার সাথে স্বামী বা স্ত্রী যে এলাকায় বসবাস করেন সেখানকার স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান বা সিটি কর্পোরেশন মেয়র বা কাউন্সিলরকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশের কপি পাঠাতে হয়।

তালাক প্রত্যাহার

তালাকের ঘোষণা দেওয়ার পরও যদি স্বামী-স্ত্রী পুনরায় মিলিত হতে চান, তবে তাদেরকে নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করতে হবে:

ইদ্দত কালের মধ্যে পুনর্মিলন:

  • ইদ্দত (তিনটি হায়েজ) শেষ হওয়ার আগে পুনর্মিলন সম্ভব।
  • পুনর্মিলনের ইচ্ছা থাকলে, স্বামী-স্ত্রী পুনরায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেন।

ইদ্দত কালের পরে পুনর্মিলন:

  • ইদ্দত কালের পরে পুনর্মিলন সম্ভব নয়।
  • পুনরায় বিবাহের জন্য হালালা বা তালাকের অন্য নিয়ম অনুসরণ করতে হবে।

ইদ্দত কাল কী?

ইসলামে তালাকের পর একজন মহিলাকে ইদ্দত পালন করতে হয়। সেই (ইদ্দত কালীন) সময়ের মধ্যে একজন মুসলীম নারীর পুন:বিবাহ ইসলামে নিষিদ্ধ। একজন মুসলীম নারীর জন্য ইদ্দত দুই প্রকার বা ভাগে ভাগ করা সম্ভব।

১)তালাকের পর

২)স্বামীর মৃত্যুর পর

 একজন মুসলীম নারীকে তার তালাকের পর ৯০ দিন বা তিন চন্দ্রমাস বা তিনটি মাসিক-চক্র অপেক্ষা করতে হবে । এই তিনটি মাসিক-চক্র (menstrual cycle phases) হচ্ছে ইদ্দত কালীন সময়।

তালাক রেজিস্ট্রেশন ফি ২০২৪

২০২৪ সালে তালাক রেজিস্ট্রেশনের জন্য সরকার নির্ধারিত ফি প্রদানের নিয়ম রয়েছে। এটি প্রতিটি অঞ্চলে আলাদা হতে পারে তবে সাধারণত ফি নিম্নরূপ:

গ্রাম এলাকায়:

  • ১,০০০ থেকে ২,০০০ টাকা।

শহর এলাকায়:

  • ২,০০০ থেকে ৫,০০০ টাকা।

বিশেষ পরিস্থিতিতে:

  • কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে ফি বাড়তে বা কমতে পারে।

তালাক রেজিস্টার ফরম এখানে ক্লিক করুন

তালাক রেজিস্টার ফরমে নিম্নোক্ত তথ্যাদি পূরণ করতে হয়:

ব্যক্তিগত তথ্য:

  • স্বামী ও স্ত্রীর নাম, ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর।

বিবাহের তথ্য:

  • বিবাহের তারিখ ও স্থান।

তালাকের কারণ:

  • তালাকের কারণ এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য।

আরও পড়ুন- নতুন পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩: সমস্যা ও প্রতিকার

তালাক নামা লেখার নিয়ম কী?

তালাক নামা লেখার সময় কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করতে হয়:

লিখিত বিবরণ:

  • তালাকের কারণ ও প্রেক্ষাপট বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করতে হবে।

সাক্ষীদের স্বাক্ষর:

  • কমপক্ষে দুইজন সাক্ষীর স্বাক্ষর থাকতে হবে।

আইনজীবীর পরামর্শ:

  • তালাক নামা লেখার আগে একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়া উচিত।

তালাক দিতে কি কি লাগে?

কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও শর্তাবলী পূরণ করতে হয়:

বিবাহের সনদপত্র:

  • বিবাহের রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট।

জাতীয় পরিচয়পত্র:

  • উভয় পক্ষের জাতীয় পরিচয়পত্র।

তালাকের নোটিশ:

  • যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে তালাকের নোটিশ প্রদান।

তালাকের সাথে মোহরানার সম্পর্ক কী? কখন আদালতের অনুমতি লাগবে?

তালাকের সময় মোহরানা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:

মোহরানা প্রদান:

  • বিবাহের সময় নির্ধারিত মোহরানা তালাকের সময় স্ত্রীর প্রাপ্য।

মোহরানা নিয়ে সমস্যা:

  • মোহরানা নিয়ে কোনো সমস্যা হলে তা সমাধানের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যায়।

তালাকের পর পুনর্বিবাহ

১৯৬১ সালের পূর্বে বাংলাদেশে নিয়ম ছিল যে, তালাকের পর স্বামী ও স্ত্রী পুনর্বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে তবে তা শর্তসাপেক্ষ। শর্তটি এই যে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে অন্য কারো সঙ্গে শরিয়া অনুসরণপূর্বক যথাযথভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে এবং নতুন স্বামী তালাক প্রদানের পর আগের স্বামীর সঙ্গে পুনর্বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ দ্বারা উক্ত শর্তটি রহিত করা হয়েছে। অর্থাৎ তালাকের পর স্বামী ও স্ত্রী যদি পুনরায় একত্রে থাকতে চায় তবে তাদের নতুন করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে অন্য কারো সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে না।

তালাক একটি জটিল প্রক্রিয়া এবং এটি সম্পন্ন করতে হলে নিয়ম-কানুন মেনে চলা জরুরি। বাংলাদেশে তালাক প্রদানের নিয়ম সম্পর্কে জানলে এই প্রক্রিয়া সহজ হয়ে যায়। আশা করি, এই ব্লগটি আপনাদের জন্য সহায়ক হবে। ধন্যবাদ।


তালাকের প্রাসঙ্গিক প্রশ্নাবলী ও উত্তর

তালাকের নোটিশ কতদিন আগে দিতে হবে?

  • কমপক্ষে ৩০ দিন আগে দিতে হবে।

তালাক প্রত্যাহার কিভাবে করা যায়?

  • ইদ্দত কালের মধ্যে পুনর্মিলনের মাধ্যমে তালাক প্রত্যাহার করা যায়।

তালাক রেজিস্ট্রেশন ফি কোথায় জমা দিতে হয়?

  • ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভায় তালাক রেজিস্ট্রেশন ফি জমা দিতে হয়।

তালাক নামা লেখার সময় কী কী লাগে?

  • বিবাহের সনদপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং তালাকের নোটিশ।

তালাকের পর মোহরানা নিয়ে সমস্যা হলে কী করতে হয়?

  • আদালতে মোহরানা নিয়ে সমস্যা সমাধান করা যায়।

তালাকের নোটিশ গ্রহণ না করলে করণীয় কী?

১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৭(১) ধারা অনুযায়ী তালাক গ্রহীতাকে তালাকের নোটিশ পাঠিয়েছেন কিন্তু তিনি নোটিশ গ্রহণ করেননি।এমতাবস্থায়, আপনার দেয়া তালাক কার্যকর হবে। আপনার দায়িত্ব নিয়ম মেনে সঠিক ঠিকানায় তালাকের নোটিশ পাঠানো। অবশিষ্ট কার্যাবলি আইন অনুযায়ী আপনা-আপনিই কার্যকর হয়ে যাবে।


g6140c1a87ff4ce7fd74e2cbe1c376edaa44a867126e9d61fc3303a019dc74a96aac8769de2d2169a7cd20b731e22ce4a_640-6930723.jpg

এই ছিল বাংলাদেশের আইনে তালাক দেয়ার নিয়ম সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা। আশা করি, এই ব্লগটি আপনাদের অনেক কাজে আসবে। যেকোনো প্রশ্ন বা মতামত জানাতে কমেন্ট করতে ভুলবেন না। ধন্যবাদ!

4 thoughts on “তালাক দেয়ার নিয়ম”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।