সামাজিক ব্যবসায় হল নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস প্রবর্তিত একশ্রেণীর অর্থনৈতিক প্রকল্প যার মূল লক্ষ্য মুনাফার পরিবর্তে মানবকল্যাণ। যে কোন সাধারণ ব্যাবসায় প্রতিষ্ঠানের মতোই এই সকল প্রকল্প পরিচালিত হয় ; কেবল লক্ষ্য থাকে মানুষের কল্যাণ—বিশেষ করে দারিদ্র ও আয়বৈষম্য দূর করা।সামাজিক ব্যবসা কেবলমাত্র দাতব্য বা সেবা নয়, বরং এটি এমন একটি ব্যবসা যেখানে বিনিয়োগকারী তার মূলধন ফিরে পান, কিন্তু মুনাফার উদ্দেশ্য ত্যাগ করেন। এর ফলে, ব্যবসার মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন সমস্যার টেকসই সমাধান করা সম্ভব হয়।
সামাজিক ব্যবসার পটভূমি
ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস বাংলাদেশে ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের সূচনা করেন। এই উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল দরিদ্র জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে মহিলাদের অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী করা। এই মডেলের সফলতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং ডঃ ইউনুস ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করেন। এই প্রাথমিক সাফল্য থেকেই সামাজিক ব্যবসার ধারণার বিকাশ ঘটে।
ডঃ ইউনুস বিশ্বাস করেন যে, সমাজের দরিদ্র এবং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে উন্নতির মূল ধারায় নিয়ে আসতে হবে। প্রচলিত ব্যবসায়িক মডেল যেখানে মুনাফা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়, সেখানে সামাজিক ব্যবসায় মানুষের মঙ্গলের উপর জোর দেওয়া হয়।
সামাজিক ব্যবসায়ের ৭টি মূলনীতি
- ১। দারিদ্র্য বিমোচনসহ এক বা একাধিক বিষয় যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি ও পরিবেশগত খাতে বিরাজমান সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিগত মুনাফাহীন কল্যাণকর ব্যবসায় এটি।
- ২। সকলের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করাই এ ব্যবসায়ের লক্ষ্য।
- ৩। সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারীরা শুধু তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থই ফেরত পাবে, এর বাইরে কোনো প্রকার লভ্যাংশ নিতে পারবে না।
- ৪। বিনিয়োগকারী তার বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত নেয়ার পর বিনিয়োগকৃত অর্থের মুনাফা কোম্পানির সম্প্রসারণ কাজে ব্যবহৃত হবে।
- ৫। এ ব্যবসায় হবে পরিবেশবান্ধব।
- ৬। এখানে যারা কাজ করবেন তারা ভালো কাজের পরিবেশ ও চলমান বাজার অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাবেন।
- ৭। সামাজিক ব্যবসায় হবে আনন্দের সাথে ব্যবসায়।
সামাজিক ব্যবসার প্রকারভেদ
সামাজিক ব্যবসাকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে:
- প্রকার ১: সামাজিক লক্ষ্যবস্তু প্রতিষ্ঠান: এই প্রকারের সামাজিক ব্যবসা এমন প্রতিষ্ঠান যা সরাসরি সামাজিক সমস্যার সমাধানে কাজ করে। এটি যেমন দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিশুদের শিক্ষা প্রদান, বা স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের জন্য কাজ করতে পারে।
- প্রকার ২: সামাজিক চাহিদার উপর ভিত্তি করে পণ্য বা সেবা: এই ধরনের সামাজিক ব্যবসা নির্দিষ্ট সামাজিক সমস্যার জন্য একটি পণ্য বা সেবা প্রদান করে, যা সাধারণ ব্যবসার মতোই পরিচালিত হয় কিন্তু লভ্যাংশ বিতরণ করে না। উদাহরণস্বরূপ, ডঃ ইউনুসের প্রতিষ্ঠিত “গ্রামীণ ডেনোন” একটি সামাজিক ব্যবসা যা দারিদ্র্যপীড়িত শিশুদের পুষ্টি সরবরাহের লক্ষ্যে দই উৎপাদন করে।
সামাজিক ব্যবসার উদাহরণ
ডঃ মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত সামাজিক ব্যবসার কিছু সাফল্য উল্লেখযোগ্য। এগুলির মধ্যে কিছু হলো:
- গ্রামীণ ব্যাংক: এটি সামাজিক ব্যবসার একটি আদর্শ উদাহরণ, যা দারিদ্র্যপীড়িত মানুষদের ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে। এই ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম মূলত নারী উদ্যোক্তাদের লক্ষ্য করে এবং তাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করে।
- গ্রামীণ ডেনোন: গ্রামীণ ব্যাংক ও ডেনোন কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে গঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি দারিদ্র্যপীড়িত শিশুদের জন্য পুষ্টিকর দই সরবরাহ করে, যা তাদের পুষ্টির ঘাটতি পূরণে সহায়ক।
- গ্রামীণ ভেওলিয়া ওয়াটার: এটি একটি যৌথ উদ্যোগ, যা বাংলাদেশের দরিদ্র গ্রামীণ এলাকায় সাশ্রয়ী মূল্যে নিরাপদ পানি সরবরাহ করে। এর মাধ্যমে পানি বাহিত রোগ প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়েছে।
- গ্রামীণ এনার্জি: গ্রামীণ এনার্জি একটি সামাজিক ব্যবসা যা বাংলাদেশে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির প্রসারে কাজ করে। এটি সৌর শক্তি ভিত্তিক প্রজেক্টের মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে মানুষের জীবনমান উন্নত করতে সহায়তা করছে।
রেফারেন্স বই- সামাজিক ব্যবসা: ড. মুহাম্মদ ইউনূস
সামাজিক ব্যবসা এবং প্রচলিত ব্যবসার মধ্যে মূল পার্থক্যগুলো হলো:
লক্ষ্য:
- সামাজিক ব্যবসা: সমাজের সমস্যার সমাধানকে অগ্রাধিকার দেয়, যেমন দারিদ্র্য দূরীকরণ, স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন।
- প্রচলিত ব্যবসা: মূল লক্ষ্য লাভ অর্জন করা এবং শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ প্রদান।
লাভ বিতরণ:
- সামাজিক ব্যবসা: বিনিয়োগকারীরা তাদের মূলধন ফেরত পান, তবে লাভের বিতরণ হয় না; মুনাফা পুনরায় সমাজে বিনিয়োগ করা হয়।
- প্রচলিত ব্যবসা: লাভ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার হিসেবে বিতরণ করা হয়।
- উদ্দেশ্য:
- সামাজিক ব্যবসা: সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাবের উপর জোর দেয়।
- প্রচলিত ব্যবসা: অর্থনৈতিক মুনাফা এবং বাজারের অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি করা।
পরিচালনা:
- সামাজিক ব্যবসা: সমাজের কল্যাণের জন্য পরিচালিত হয়, যেখানে টেকসই উন্নয়ন প্রধান উদ্দেশ্য।
- প্রচলিত ব্যবসা: প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার জন্য পরিচালিত হয়, যেখানে লাভ সর্বাধিককরণ মূল লক্ষ্য।
সামাজিক ব্যবসার বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা
ডঃ মুহাম্মদ ইউনুসের সামাজিক ব্যবসার ধারণা ইতিমধ্যে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে এবং এটি এখন অনেক দেশে বাস্তবায়িত হচ্ছে। জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ ডঃ ইউনুসের সামাজিক ব্যবসার মডেল অনুসরণ করে সমাজের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে কাজ করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বিজনেস স্কুলগুলো সামাজিক ব্যবসার ধারণা নিয়ে গবেষণা এবং অধ্যয়ন করছে এবং নতুন উদ্যোক্তাদের এই মডেল অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করছে।
চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ
সামাজিক ব্যবসার প্রচলন এবং প্রসারের পথে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন, প্রচলিত ব্যবসায়িক মডেলের তুলনায় সামাজিক ব্যবসার মডেল গ্রহণে বেশ কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এছাড়াও, সামাজিক ব্যবসার আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখাও একটি চ্যালেঞ্জ। তবে ডঃ ইউনুসের প্রবর্তিত এই মডেল ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছে যে এটি শুধু টেকসইই নয়, বরং একটি সম্ভাবনাময় মডেল, যা ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে পারে।
সামাজিক ব্যবসা একটি মানবিক ব্যবসার ধারণা, যা সমাজের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। ডঃ মুহাম্মদ ইউনুসের এই মডেল ভবিষ্যতে ব্যবসার ধারা পরিবর্তন করতে পারে এবং বিশ্বকে একটি সমতা ও ন্যায়বিচারপূর্ণ সমাজের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
আরও দেখুন- ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস এর তিন শূন্যের পৃথিবী
[…] আরও পড়ুন- ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস প্রবর্তিত … […]