জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্ক কেন ?
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রসঙ্গটি, বর্তমান সময়ের অন্যতম আলোচিত একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আয়নাঘরে বন্দি থাকা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লহিল আমান আযমী এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতকে ‘স্বাধীনতার অস্তিত্বের পরিপন্থি’ উল্লেখ করে, জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করার দাবি জানান। এরপর থেকেই দেশের নাগরিকরা দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদল বলছে জাতীয় সংগীতের সঙ্গে কোন আপোষ নয়, এই সঙ্গীত বাঙালীর সর্বোচ্চ আবেগের জায়গা। অন্য দল বলছে, গানটি যেহেতু সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছিল; এবং তা ছিল বাংলাদেশ ধারণার পরিপন্থী; তাই এই জাতীয় সংগীত অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। আমার সোনার বাংলা গানটি কিভাবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতে হয়েছিল এবং এই গানটি নিয়ে এত বিতর্ক কেন, সে সম্পর্কে আলোচনা করা হচ্ছে এই ব্লগে।
জাতীয় সংগীতের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা” মূলত ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে রচিত হয়। এটি বাংলা ভাষার প্রতীকী গুরুত্বকে তুলে ধরে, যা পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির স্বাধীনতার প্রেরণায় পরিণত হয়। স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালে এটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
বিতর্কের সূচনা
জাতীয় সংগীত পরিবর্তন নিয়ে বিতর্কের সূচনা মূলত তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে।
প্রথমত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হলেও তিনি ভারতেরও জাতীয় সংগীতের রচয়িতা। ফলে কিছু মহল থেকে দাবি করা হচ্ছে যে, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করে একটি ‘খাঁটি’ বাংলাদেশি রচিত গানকে জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করা উচিত।
দ্বিতীয়ত, বিদ্যমান জাতীয় সংগীত রচনার প্রেক্ষাপট ছিলো ১৯০৫ সালের ‘বঙ্গভঙ্গ’। যা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়।
তৃতীয়ত, কথিত আছে যে, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা” গানটির সুর গগণ হরকরা রচিত “আমি কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যে রে” এই গানটির সুর থেকে নকল করা হয়েছে।
গানটি শুনুন- আমি কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যে রে
বিতর্কের মূল কারণসমূহ
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারতীয় পরিচয়
বিতর্কের প্রধান একটি দিক হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারতীয় পরিচয়। সমালোচকদের মতে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ এবং তার নিজস্ব জাতীয় সংগীত থাকা উচিত যা কোনো ভারতীয় ব্যক্তির রচনা নয়। তাদের মতে, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা হওয়ায় এর মধ্যে একটি পরাধীনতার ছাপ রয়ে গেছে। এই মহল থেকে দাবি করা হচ্ছে যে, দেশের একজন বাঙালি কবি বা লেখকের লেখা একটি গান জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করা উচিত।
২. ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আপত্তি
বাংলাদেশে কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠী থেকে জাতীয় সংগীতের কিছু অংশ নিয়ে আপত্তি জানানো হয়েছে। তারা দাবি করেছে যে, জাতীয় সংগীতের কিছু শব্দ এবং বাক্যাংশ ইসলামী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যেমন “সোনার বাংলা” শব্দবন্ধটি নিয়ে তাদের আপত্তি রয়েছে। তাদের মতে, “সোনা” বা সোনার মতো বস্তুবাদী ধারণা ব্যবহার করা ইসলামি চেতনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যদিও এই দাবি ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, তবে এটি বিতর্ককে আরও উসকে দিয়েছে।
৩. ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের প্রশ্ন
আরেকটি বিতর্কিত বিষয় হলো জাতীয় সংগীতের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বাংলার প্রকৃতি এবং সাধারণ মানুষের জীবনধারা নিয়ে লেখা হয়েছে। তবে অনেকেই মনে করেন যে, এটি শুধুমাত্র গ্রামীণ বাংলার চিত্র তুলে ধরছে এবং আধুনিক বাংলাদেশকে প্রতিফলিত করছে না। কিছু সমালোচক মনে করেন, জাতীয় সংগীতে দেশের শিল্প, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং বর্তমান সময়ের অগ্রগতির প্রতিফলন থাকা উচিত।
৪. গানের সুর নকলের প্রশ্ন
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা” গানটির সুর গগণ হরকরা রচিত “আমি কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যে রে” এই গানটির সুর থেকে নকল করা হয়েছে বলে অনেকেই দাবী করছেন।
৫ রচনার প্রেক্ষাপটগত প্রশ্ন
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই গানটি রচিত হয়েছিলো। ১৩ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে মন্ত্রিসভার প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে এ গানটির প্রথম দশ চরণ সদ্যগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত হয়। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “বাউল” নামক গ্রন্থে গানটি অন্তর্ভুক্ত আছে। গানটির রচনাকাল ১৯৭১ এর পূর্বে আর গানটি রচনার প্রেক্ষাপট ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত নয় বলে অনেকেই মনে করছেন।
জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের পক্ষে ও বিপক্ষে মতামত
পরিবর্তনের পক্ষে
পরিবর্তনের পক্ষে যারা রয়েছেন, তারা মূলত তিনটি কারণকে সামনে আনছেন:
- সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য: তারা মনে করেন যে, বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি, সাহিত্য এবং ঐতিহ্যকে তুলে ধরার জন্য নতুন একটি জাতীয় সংগীত প্রয়োজন।
- আধুনিকতা ও বৈশ্বিক পরিচিতি: আধুনিক বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্বকারী একটি গান প্রয়োজন যা দেশের বর্তমান চেতনা, অগ্রগতি এবং আন্তর্জাতিক সাফল্যকে প্রতিফলিত করবে।
- ধর্মীয় অনুভূতি: কিছু ধর্মীয় মহল মনে করে, বর্তমান জাতীয় সংগীত তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং এটি পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে।
পরিবর্তনের বিপক্ষে
যারা জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের বিপক্ষে, তাদের যুক্তি হলো:
- ঐতিহাসিক ও আবেগপূর্ণ সম্পর্ক: “আমার সোনার বাংলা” শুধু একটি গান নয়, এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। এর প্রতিটি শব্দ বাঙালির স্বাধীনতার চেতনা এবং আত্মপরিচয়ের প্রতীক।
- সংস্কৃতির অংশ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিকে বাঙালির মহান সংস্কৃতির অংশ হিসেবে দেখা হয়। তার লেখা জাতীয় সংগীত কেবল বাংলাদেশের নয়, বাঙালি জাতির জন্য একটি অমূল্য সম্পদ।
- অপ্রয়োজনীয় পরিবর্তন: জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করা মানে দেশের ঐতিহ্য এবং চেতনার একটি বড় অংশকে পরিবর্তন করা। এই পরিবর্তন শুধু অপ্রয়োজনীয়ই নয়, বরং দেশের জাতীয় ঐক্য ও গর্বকে আঘাত করতে পারে।
সরকারের অবস্থান
জাতীয় সংগীত পরিবর্তন বিতর্ক নিয়ে সরকার এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে জাতীয় সংগীতের গুরুত্ব এবং তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে সম্মান জানানো হয়েছে। জাতীয় সংগীতের বর্তমান অবস্থান বজায় রাখার পক্ষে সমর্থন দেখা গেছে।
উপসংহার
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তন বিতর্ক দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং জাতীয় চেতনার গভীর বিষয়গুলিকে ছুঁয়ে গেছে। এই বিতর্ক জাতিকে বিভক্ত করার পরিবর্তে একটি সুস্থ আলোচনা এবং মত বিনিময়ের সুযোগ তৈরি করেছে। তবে, জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং মানুষের আবেগকে সম্মান জানানো গুরুত্বপূর্ণ।
“আমার সোনার বাংলা” শুধু একটি গান নয়, এটি বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস এবং স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রতীক। তাই, এই বিতর্কের মধ্যেও জাতীয় সংগীতের মর্যাদা এবং তাৎপর্য অটুট রাখা উচিত।
যৌক্তিক আলোচনা।
[…] […]
[…] […]