জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ময়নুল ইসলাম শাহ্
জলবায়ু পরিবর্তন আজকের বিশ্বে একটি জরুরি ও তীব্র বাস্তবতা। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, বরফ গলার হার বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, এবং অস্বাভাবিক আবহাওয়া বিভিন্ন দেশকে গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন করছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশেষভাবে ঝুঁকিতে রয়েছে, কারণ এই দেশের ভৌগোলিক অবস্থান এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে বেশি প্রবণ। এই ব্লগে আমরা পরিবেশগত সুরক্ষার জন্য প্রযোজ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন এবং নীতিমালার ওপর আলোকপাত করব এবং বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার বর্তমান অবস্থান ও ভবিষ্যত পরিকল্পনার উপর আলোচনা করব।
পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালা
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং পরিবেশের সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং প্রটোকল বিদ্যমান রয়েছে, যার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী দেশগুলো সম্মিলিতভাবে কাজ করছে:
- প্যারিস চুক্তি (২০১৫): প্যারিস চুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ১.৫° সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করে। এটি কার্বন নিঃসরণের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অভিযোজন ও প্রশমন কৌশল গড়ে তোলার জন্য একটি আন্তর্জাতিক কাঠামো প্রদান করে।
- কিয়োটো প্রটোকল (১৯৯৭): এটি একটি আগের চুক্তি, যা বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে কার্বন নিঃসরণের উপর নির্দিষ্ট কোটা আরোপ করেছিল। যদিও প্যারিস চুক্তি এর স্থান নিলেও কিয়োটো প্রটোকল জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণে একটি বড় পদক্ষেপ ছিল।
- বহুপাক্ষিক পরিবেশ চুক্তি (MEAs): বিশ্বের অনেক দেশ এই চুক্তির সদস্য, যা প্রাকৃতিক সম্পদ এবং পরিবেশের সুরক্ষার জন্য কাজ করে।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত আইন
বাংলাদেশে পরিবেশ সুরক্ষার জন্য বেশ কয়েকটি জাতীয় আইন ও নীতিমালা রয়েছে। এগুলি মূলত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সরকারের প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে:
- বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (১৯৯৫): এই আইন দেশের পরিবেশগত সম্পদের সুরক্ষার জন্য প্রণীত হয়েছে। এটি পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের উপর গুরুত্ব দেয়।
- বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্ম পরিকল্পনা (BCCSAP): এটি ২০০৯ সালে চালু হয়েছিল এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি কর্ম পরিকল্পনা হিসাবে কাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে উপকূলীয় সুরক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা, এবং টেকসই কৃষি ব্যবস্থা।
- ডেল্টা প্ল্যান ২১০০: এটি বাংলাদেশের একটি উদ্ভাবনী এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পরিকল্পনা, যা ২১০০ সাল পর্যন্ত দেশের পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নীতিমালা নির্ধারণ করে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। যদিও দেশটি কার্বন নিঃসরণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে না, তবুও এটি জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের শিকার। বাংলাদেশের মূল চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে রয়েছে:
- উপকূলীয় এলাকা ক্ষতি: বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে প্লাবিত হচ্ছে, যার ফলে লোকজনের জীবিকা এবং বাসস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
- খাদ্য নিরাপত্তা: অতিরিক্ত বৃষ্টি এবং খরার কারণে কৃষিক্ষেত্রের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলছে।
- জলবায়ু উদ্বাস্তু বৃদ্ধি: বন্যা এবং নদীর ভাঙনের কারণে হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে। এদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পুনর্বাসন প্রয়োজন।
সাম্প্রতিক ঘটনা ও উদ্যোগ
২০২৩ সালের সিপিসি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের সরকার এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা একসঙ্গে কাজ করে জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক উদ্যোগগুলির মধ্যে রয়েছে:
- জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের সম্প্রসারণ: সৌর শক্তি এবং বায়ু শক্তির মতো নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা হচ্ছে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।
- সবুজ অর্থনীতি উন্নয়ন: পরিবেশ-বান্ধব উৎপাদন, কৃষি ও শিল্প খাতের উন্নয়নে সরকারের সবুজ অর্থনীতি কর্মসূচি শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা
বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যত পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হলো:
- উপকূলীয় সুরক্ষা বাড়ানো: সরকারের লক্ষ্য উপকূলীয় এলাকাগুলি আরও শক্তিশালী ও টেকসই করা। এর জন্য বাঁধ নির্মাণ, ম্যানগ্রোভ বনায়ন এবং পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন চলছে।
- জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষি: খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য উন্নত কৃষি প্রযুক্তি এবং জলবায়ু সহিষ্ণু ফসলের উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
- আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি: জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক অর্থায়ন ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রাপ্তির জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
সমস্যার সমাধান
জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যার সমাধানে কয়েকটি মূল পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:
- কার্বন নিঃসরণ হ্রাস: বাংলাদেশকে নবায়নযোগ্য শক্তি, বিশেষ করে সৌর এবং বায়ু শক্তির দিকে মনোযোগ দিতে হবে, যা ইতিমধ্যে অনেকাংশে শুরু হয়েছে।
- সচেতনতা বৃদ্ধি: জনগণের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে তারা স্থানীয়ভাবে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারে।
- বহুপাক্ষিক সহযোগিতা: বৈশ্বিক অর্থায়ন ও প্রযুক্তি প্রাপ্তির জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানো জরুরি।
উপসংহার
জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ। যাহোক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আইন এবং নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আরও কার্যকরী পদক্ষেপ প্রয়োজন। সরকারের বর্তমান উদ্যোগগুলো আশাব্যঞ্জক হলেও, ভবিষ্যতের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ অপরিহার্য।
Want to read
[…] আরও পড়ুন- জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ … […]