battle, war, attack

বাংলাদেশ আনসার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আনসার ব্যাটালিয়ন আইন, ২০২৩: বিস্তারিত বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের আনসার বাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, আনসার সদস্যদের মধ্যে কর্মপরিবেশ, বেতন কাঠামো এবং শৃঙ্খলা সংক্রান্ত অসন্তোষ একটি বড় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে, যার প্রেক্ষিতে নতুন করে আইন সংস্কার করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এই প্রেক্ষাপটে ২০২৩ সালে পাস করা হয়েছে আনসার ব্যাটালিয়ন আইন, ২০২৩, যা আনসার বাহিনীর কার্যক্রম, শৃঙ্খলা রক্ষা এবং শাস্তির জন্য একটি নতুন কাঠামো প্রদান করে।

আনসার বাহিনীর ভূমিকা ও প্রেক্ষাপট:

বাংলাদেশ আনসার বাহিনী একটি আধাসামরিক বাহিনী হিসেবে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় নির্বাচন এবং জরুরি অবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকে। তাদের ভূমিকা বিশেষ করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং পুলিশের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। আনসার সদস্যদের অনেকে সীমান্ত এলাকায় এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিয়োজিত থাকেন, যেখানে তাদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে থাকে।

আনসার বাহিনীর দায়িত্ব, কর্তব্য ও কাজ কী?

১। আনসার ও ভিডিপি’র প্রধান দায়িত্ব হলো-

(ক) দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে জনকল্যাণমূলক কাজে অংশ গ্রহণ করা।

(খ) আইন-শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তামূলক কাজে সহায়তা প্রদান করা।

(গ) সরকার কর্তৃক, সময় সময় নির্ধারিত যেকোন দায়িত্ব পালন করা।

২। সরকার কর্তৃক প্রণীত নীতিমালা এবং তৎকর্তৃক, সময় সময়, প্রদত্ত নির্দেশ ও আরোপিত শর্ত সাপেক্ষে আনসার ও ভিডিপি’র সদস্য/সদস্যাগণ অস্ত্র গোলাবারুদ বহন ও ব্যবহার করতে পারবে।

আদেশ পালনে বাধ্যবাধকতাঃ-

আনসার ও ভিডিপি’র সদস্য/সদস্যাগণ যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তাদেরকে প্রদত্ত আইনানুগ আদেশ পালনে বাধ্য থাকবে।

আনসার ও ভিডিপি’র সংগঠনঃ-

বাংলাদেশের প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে আনসার ও ভিডিপি’র ২টি (দল) প্লাটুন রয়েছে। এর ১টি পুরুষদের দল এবং অন্যটি মহিলাদের দল। প্রত্যেক দলে রয়েছে ৩২ জন করে পুরুষ বা মহিলা। তাদের মধ্যে ১ জন দলনেতা/দলনেত্রী, বাকী ৩০ জন সদস্য/সদস্যা। এই ৩০ জন আবার ৩টি সেকশন বা শাখা দলে বিভক্ত থাকে।

আনসার বাহিনীর অসন্তোষ ও আন্দোলনঃ

সাম্প্রতিক সময়ে আনসার বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অসন্তোষ এবং আন্দোলনের কারণগুলি মূলত তাদের চাকরির অনিশ্চয়তা, বেতন এবং সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত সমস্যার ওপর কেন্দ্রীভূত। আনসার বাহিনীর সদস্যরা প্রায়ই তাদের কাজের কঠোরতা এবং ঝুঁকির তুলনায় নিম্ন বেতন এবং সুবিধার অভাবের অভিযোগ করে থাকেন। এসব সমস্যা দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত হয়ে আসছে এবং এই অসন্তোষ ২০২৩ সালের আনসার ব্যাটালিয়ন আইন প্রণয়নের পেছনে একটি বড় কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

আনসার ব্যাটালিয়ন আইন, ২০২৩-এর মূল ধারা:

আনসার ব্যাটালিয়ন আইন, ২০২৩-এর প্রস্তাবিত এবং পাস হওয়া সংস্করণটি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এবং কঠোর শাস্তির বিধান এনেছে। আইনের প্রধান বিষয়গুলো নিম্নরূপ:

  1. বিদ্রোহ দমনের কঠোরতা:
    আইনটির মূল বৈশিষ্ট্য হলো বিদ্রোহ বা শৃঙ্খলাভঙ্গের ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা। আইন অনুযায়ী, আনসার বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে কেউ শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে বা বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিলে তার জন্য ‘মৃত্যুদণ্ডের বিধান’ রাখা হয়েছে। এই বিধানটি বাংলাদেশে বিদ্রোহ দমনে কঠোর শৃঙ্খলা বজায় রাখার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
  2. আত্মরক্ষার অধিকার:
    আইনে আনসার বাহিনীর সদস্যদের শৃঙ্খলা ভঙ্গের সময় প্রতিরোধ করতে গিয়ে আত্মরক্ষার জন্য বলপ্রয়োগের অধিকার দেওয়া হয়েছে, যা বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তা এবং শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ক্ষমতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
  3. দণ্ড ও শাস্তির পরিধি:
    বিদ্রোহ এবং শৃঙ্খলাভঙ্গের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি আজীবন কারাবাসের বিধানও রয়েছে। তবে, মৃত্যুদণ্ডের ব্যবহারের বৈধতা নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং মানবাধিকার সংস্থা সমালোচনা করেছে। JusticeMakers Bangladesh এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শাহানুর ইসলাম বলেন, “মৃত্যুদন্ড অপরাধ দমনের একটি কার্যকর পদ্ধতি নয় এবং এর চেয়ে মানবাধিকার সম্মত শাস্তি হওয়া উচিত”। এই আইনের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডের চেয়ে আজীবন কারাবাসকে শাস্তি হিসেবে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
  4. প্রশাসনিক দায়িত্ব ও নিয়ন্ত্রণ:
    নতুন আইনে আনসার বাহিনীর প্রশাসনিক কাঠামোকে আরও শক্তিশালী এবং সুশৃঙ্খল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলোও আনা হয়েছে।

আনসার বাহিনীর চলমান আন্দোলন ও সমস্যাগুলো:

আনসার বাহিনীর মধ্যে চলমান আন্দোলন মূলত কাজের পরিবেশ, বেতন কাঠামো এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অভাব নিয়ে। দীর্ঘদিন ধরে আনসার সদস্যরা ন্যায্য বেতন, স্থায়ী চাকরির সুযোগ এবং কাজের নিরাপত্তার জন্য আন্দোলন করে আসছেন। ১৯৯৪ সালের বিদ্রোহ ছিল এর একটি বড় উদাহরণ, যেখানে হাজার হাজার আনসার সদস্য বেতন বাড়ানোর দাবিতে বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহ দমনের পরও আনসার বাহিনীতে শৃঙ্খলার সমস্যা রয়েই গেছে, যা নতুন করে আলোচনায় আসে।

আনসার বাহিনীর সদস্যদের মতে, তারা প্রায়শই সীমিত সুবিধা এবং ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করেন। এ কারণে তারা নতুন আইন এবং এর শাস্তির বিধান নিয়ে উদ্বিগ্ন। শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান আনসার বাহিনীর সদস্যদের অসন্তোষ আরও বাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। একদিকে এই আইন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্য থাকলেও, অপরদিকে সদস্যদের দাবি পূরণ না হলে এটি নতুন সমস্যা তৈরি করতে পারে।

আইনের পক্ষে ও বিপক্ষে মতামত:

আনসার ব্যাটালিয়ন আইন, ২০২৩ নিয়ে বিভিন্ন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। আইনটির পক্ষে বলা হচ্ছে, এটি বাহিনীর শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং সরকারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। নতুন আইন শৃঙ্খলা এবং সুশৃঙ্খল কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। আনসার বাহিনীর সদস্যরা যেন শৃঙ্খলাভঙ্গ না করে এবং তাদের কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালিত হয়, সেই উদ্দেশ্যে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।

তবে আইনটির সমালোচকরা বলছেন, শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান মানবাধিকারের পরিপন্থী। বাংলাদেশে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী বিদ্রোহ দমন করতে মৃত্যুদণ্ডের প্রয়োজন নেই বলে মনে করছেন অনেকে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, আনসার বাহিনীর সদস্যদের সাথে মানবিক আচরণ করা উচিত এবং তাদের অধিকার ও চাহিদার প্রতি সম্মান দেখানো উচিত। কঠোর শাস্তি না দিয়ে শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য আরও গ্রহণযোগ্য উপায় অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক মান ও মানবাধিকার:

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করে এসেছে, বিশেষ করে শৃঙ্খলাভঙ্গ বা বিদ্রোহের মতো অপরাধের জন্য। তারা মনে করে, মৃত্যুদণ্ড অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকর কোনো সমাধান নয় এবং এটি অপরাধীদের পুনর্বাসনের সুযোগ নষ্ট করে। এই প্রেক্ষিতে, বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ রয়েছে যেন তারা আনসার ব্যাটালিয়ন আইনের শাস্তির বিধান পুনর্বিবেচনা করে এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পরামর্শ গ্রহণ করে।

আনসার ব্যাটালিয়ন আইন, ২০২৩ আনসার বাহিনীর শৃঙ্খলা বজায় রাখতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও, এর কার্যকারিতা এবং প্রয়োগ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। আইনটির মাধ্যমে বাহিনীর কার্যক্রম সুশৃঙ্খল হবে বলে আশা করা হচ্ছে, তবে এর কঠোর শাস্তির বিধান আনসার বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে আরও অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে। মানবাধিকার ও শৃঙ্খলার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে সরকারকে যথাযথভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে।

আনসার ব্যাটালিয়ন আইন, ২০২৩

আরও পড়ুন- ভারতের ইতিহাসে মুসলমানদের অবদান

One thought on “আনসার ব্যাটালিয়ন আইন, ২০২৩: শৃঙ্খলা রক্ষার নতুন অধ্যায় নাকি মানবাধিকারের চ্যালেঞ্জ?”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।