সরকারি চাকুরীর বয়স ৩৫ কি যৌক্তিক?
বাংলাদেশে সরকারি চাকরির বয়সসীমা দীর্ঘদিন ধরেই একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। বর্তমানে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রার্থীদের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ বছর নির্ধারিত রয়েছে। তবে অনেকেই এই বয়সসীমা ৩৫ বছরে উন্নীত করার দাবি জানাচ্ছেন। এই প্রসঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি, কারণ এবং এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা যাক।
১. বর্তমান বয়সসীমার প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বর্তমানে ৩০ বছরের বয়সসীমা আরোপিত, যা ১৯৯১ সালে নির্ধারিত হয়েছিল। তবে এই সময়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা, শিক্ষাব্যবস্থা, এবং কর্মসংস্থানের পরিস্থিতি ছিল বর্তমানের তুলনায় ভিন্ন। গত তিন দশকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ও উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারীদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, তবে সে তুলনায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সেভাবে বৃদ্ধি পায়নি। এর ফলে অনেক তরুণ বেকারত্বের মুখোমুখি হচ্ছে, যারা চাকরির বাজারে প্রবেশের আগেই বয়সসীমা অতিক্রম করে ফেলে।
২. বয়সসীমা ৩৫ করা যৌক্তিক হওয়ার পক্ষে যুক্তি
২.১ শিক্ষাজীবনের দীর্ঘায়িত সময়কাল
বর্তমানে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করতে গড়ে ২৪ থেকে ২৬ বছর বয়স পর্যন্ত সময় নেয়। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করতে তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বছরগুলো কেটে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই নানা কারণে শিক্ষাজীবন বিলম্বিত হয়, যেমনঃ ফল পুনঃমূল্যায়ন, পরিক্ষার তারিখ পেছানো বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট। ফলে ৩০ বছরের মধ্যে সরকারি চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। বয়সসীমা ৩৫ করা হলে শিক্ষার্থীরা বেশি সময় নিয়ে তাদের শিক্ষা এবং কর্মজীবনের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য রক্ষা করতে পারবে।
২.২ প্রতিযোগিতার চাপ কমানো
সরকারি চাকরির পরীক্ষায় প্রচুর প্রার্থী অংশ নেয়, যার মধ্যে অধিকাংশই শেষ বয়সসীমার কাছাকাছি থাকে। এই প্রবল প্রতিযোগিতার চাপ তরুণ প্রার্থীদের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। বয়সসীমা বাড়ানো হলে প্রার্থীরা একটু স্বস্তিতে প্রস্তুতি নিতে পারবে এবং আরও আত্মবিশ্বাসীভাবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে।
২.৩ বেকারত্বের চাপ কমানো
বাংলাদেশে বেকারত্ব একটি বড় সমস্যা। অনেকেই শিক্ষাজীবন শেষ করার পর কিছু সময় বেকার থাকতে বাধ্য হয়, কারণ বাজারে পর্যাপ্ত চাকরির সুযোগ নেই। বয়সসীমা ৩৫ করা হলে শিক্ষার্থীরা বেকারত্বের চাপ থেকে কিছুটা রেহাই পাবে এবং আরও সময় নিয়ে উপযুক্ত চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিতে পারবে।

২.৪ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
অনেক দেশেই সরকারি চাকরির জন্য বয়সসীমা ৩৫ বা তার বেশি। যেমন, ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা ৩৫ বছর, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে আরও বেশি। বাংলাদেশেও এই ধরনের আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে বয়সসীমা বাড়ানো হতে পারে।
৩. বয়সসীমা ৩৫ করা যৌক্তিক নয় বলে যেসব যুক্তি দেওয়া হয়
৩.১ কর্মদক্ষতার প্রশ্ন
কিছু সমালোচক মনে করেন, বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের শারীরিক এবং মানসিক কর্মদক্ষতা কমতে থাকে। কম বয়সে তরুণরা কর্মদক্ষতা, উদ্যম এবং শক্তি দিয়ে কাজ করতে পারে। তাই তাদের মনে করা হয় যে, বয়সসীমা বাড়ালে যোগ্য প্রার্থীরা বাদ পড়বে এবং অপেক্ষাকৃত বয়স্ক প্রার্থীরা বেশি সুবিধা পাবে, যা কর্মদক্ষতা কমানোর সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।
৩.২ কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির সুযোগ
সরকারি চাকরিতে কর্মজীবনের প্রথমদিকে ঢুকলে অনেক বেশি সময় পাওয়া যায় পদোন্নতির জন্য। বয়সসীমা ৩৫ করা হলে, অনেকেই অনেক পরে কর্মজীবন শুরু করবে, যার ফলে তারা দীর্ঘমেয়াদী ক্যারিয়ারের সুযোগ এবং পদোন্নতির সুবিধা কম পাবে।
৩.৩ পেনশনের বিষয়
সরকারি চাকরিতে পেনশন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বয়সসীমা বাড়ালে চাকরিজীবনের দৈর্ঘ্য কমে যাবে, ফলে পেনশন দেওয়ার জন্য সরকারের উপর আর্থিক চাপ বাড়তে পারে। এতে সরকারকে বেশি বয়সী কর্মীদের জন্য অতিরিক্ত পেনশন খরচ বহন করতে হতে পারে।
৪. সমাধানের পথ
৪.১ নিয়মিত পরীক্ষা গ্রহণ
বয়সসীমা বাড়ানোর পাশাপাশি নিয়মিত পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে চাকরির সুযোগ বাড়ানো যেতে পারে। যদি পরীক্ষার সংখ্যা বেশি হয়, তবে প্রার্থীরা বিভিন্ন সময়ে চাকরির জন্য আবেদন করার সুযোগ পাবে এবং বয়সের সীমাবদ্ধতা তাদের প্রভাবিত করবে না।
৪.২ বিশেষ কোটার ব্যবস্থা
যেসব শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন বিলম্বিত হয়, তাদের জন্য বিশেষ কোটা বা বয়স ছাড় দেওয়া যেতে পারে। যেমন: মহিলাদের জন্য, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য, বা যেসব প্রার্থীরা প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে বিলম্বিত হয়েছেন, তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
৫. উপসংহার
বাংলাদেশে সরকারি চাকরির বয়সসীমা ৩৫ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সমসাময়িক ইস্যু। এটি একদিকে শিক্ষার্থীদের বেকারত্বের চাপ কমাতে সহায়ক হতে পারে, অন্যদিকে কর্মদক্ষতার প্রশ্নও তুলতে পারে। সঠিকভাবে চিন্তা-ভাবনা এবং বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। সরকার, শিক্ষাবিদ, এবং তরুণ সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধান বের করা সম্ভব, যা দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে উপকারী হবে।