Moynul Islam Shah

তিস্তা নদীর সংকট এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

তিস্তা নদী বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত একটি নদী। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা তার স্বাভাবিক প্রবাহ হারায়, যার ফলে বাংলাদেশে কৃষি, মৎস্য ও স্থানীয় জনগণের জীবিকা হুমকির মুখে পড়ে। বিশেষ করে উত্তরের লালমনিরহাট, নীলফামারী, দিনাজপুর, রংপুর, কুড়িগ্রাম, বগুড়াসহ কয়েকটি জেলার কৃষিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এদিকে, তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প থেকে যে সুবিধা পাওয়ার কথা এসকল জেলার মানুষের সেটিও বাঁধার সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। অপরদিকে বর্ষা মৌসুমে ভারত উজানের সকল বাঁধ খুলে দেয়ার কারণে অতিরিক্ত পানির ঢল আসে, যা এই জনপদে ভয়াবহ বন্যা ও নদীভাঙনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার তিস্তার পানি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আপত্তি তুলেছে, যা বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বারবার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তির বাস্তবায়নের দাবি তোলা হলেও, তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। উপরন্তু তিস্তা একটি আন্তঃদেশীয় নদী হওয়ার কারণে এতে ভারতের একতরফা বাঁধ নির্মাণ করাটা সরাসরি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।

আন্তর্জাতিক নদীতে বাঁধ নির্মাণের নীতিমালা পড়ুন এখানে


তিস্তা নদীর পানিশূন্যতা: ভারতের অবৈধ বাঁধ নির্মাণের প্রভাব

তিস্তা নদী বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী, তবে শুষ্ক মৌসুমে এতে প্রায় পানি থাকেই না। এর প্রধান কারণ হলো, ভারতের উত্তরাঞ্চলে তিস্তার উজানে একাধিক বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবা ব্যারেজের মাধ্যমে ভারত একতরফাভাবে তিস্তার পানি নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে শীতকালে তিস্তা নদী শুকিয়ে যায় এবং বাংলাদেশ অংশে কৃষি, মৎস্য ও পরিবেশ চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভারত আন্তর্জাতিক পানিসম্পদ আইন লঙ্ঘন করে তিস্তার স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত করছে। দুই দেশের মধ্যে ২০১১ সালে একটি পানিবণ্টন চুক্তির প্রস্তাবনা গৃহীত হলেও তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলাদেশের জনগণ দীর্ঘদিন ধরে ন্যায্য পানির দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। তিস্তা মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে নদী পুনরুদ্ধার ও পানি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করাও প্রয়োজন। অন্যথায়, তিস্তা নদীর ভবিষ্যৎ আরও সংকটাপন্ন হতে পারে।


‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য

সম্প্রতি বিএনপি উদ্যোগ নিয়েছে ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’ শীর্ষক আন্দোলন। ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’ কর্মসূচি তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে তিস্তা নদীর তীরবর্তী পাঁচটি জেলার ১৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ৪৮ ঘণ্টার একটি আন্দোলন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এই কর্মসূচির আয়োজন করেছে, যা ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে শুরু হয় এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে শেষ হয়। কর্মসূচির উদ্বোধন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, এবং সমাপনীতে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। যা মূলত তিস্তা নদী নিয়ে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের দাবি পুনরায় সামনে আনছে।


জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই আন্দোলনের প্রধান দাবিগুলো হলো:

  • তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন: তিস্তা নদীর তীরে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে বাঁধ নির্মাণ, সেচ প্রকল্পের সম্প্রসারণ এবং স্থানীয় কৃষকদের সুবিধার জন্য পানি সংরক্ষণ।
  • তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা: ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে পানিবণ্টন চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি।
  • নদীভাঙন ও বন্যার স্থায়ী সমাধান: বর্ষা মৌসুমে তিস্তার পানির অতিরিক্ত প্রবাহে যেন ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে না হয়, তার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।

তিস্তা মহাপরিকল্পনা কী?

বাংলাদেশ সরকারের একটি সমন্বিত প্রকল্প, যার উদ্দেশ্য তিস্তা নদীর পানি সংরক্ষণ, নদীভাঙন প্রতিরোধ এবং সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ করা। এই পরিকল্পনার আওতায় নদীর তীরে বাঁধ নির্মাণ, জলাধার তৈরি এবং নদী শাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে তিস্তা পাড়ের কৃষি, পরিবেশ ও জনজীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

তিস্তা মহাপরিকল্পনা pdf দেখুন


রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ

বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে তাদের রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে ব্যবহার করে। বিএনপির এই আন্দোলনও সেই ধারাবাহিকতারই অংশ।

সরকারের ভূমিকা

মুহম্মাদ ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে, তবে দীর্ঘসূত্রতার কারণে এখনো কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। সরকার ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে চাইছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত তা সফল হয়নি।

বিরোধী দলের কৌশল

বিএনপি এই আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরতে চাইছে এবং জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এর পাশাপাশি, তিস্তা নদী সম্পর্কিত ইস্যুকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও আলোচনায় আনতে চায় তারা।

জনমতের প্রতিক্রিয়া

এই আন্দোলন ইতিমধ্যে স্থানীয় জনগণের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে, কারণ তিস্তা পারের মানুষ নদীর পানি সংকট ও নদীভাঙনের কারণে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। তবে রাজনৈতিক মহলে এ নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। সরকারি দল এটিকে বিএনপির রাজনৈতিক চাল হিসেবে দেখছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ বিষয়টিকে তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ করছে।


তিস্তা (হার্ডকভার)
কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার প্রাপ্ত উপন্যাস
by হারুন পাশা

তিস্তা (উপন্যাস) অর্ডার করতে ক্লিক করুন

হারুন পাশা রচিত কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার প্রাপ্ত উপন্যাস

‘তিস্তা’ উপন্যাসটি হলো বাংলাদেশ ভূখণ্ডের পানিহীন তিস্তা নদী, তিস্তা ব্যারেজ এবং নদী তীরবর্তী মানুষের সংকটাপন্ন জীবনের আখ্যান।


তিস্তা সংকটের ভবিষ্যৎ ও করণীয়

তিস্তা সমস্যা সমাধানের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি:

  1. দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক আলোচনা জোরদার করা: ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি দ্রুত কার্যকর করতে হবে।
  2. তিস্তা মহাপরিকল্পনার দ্রুত বাস্তবায়ন: বাংলাদেশের নিজস্ব উদ্যোগে নদী ব্যবস্থাপনা, জলাধার নির্মাণ ও কৃষি সেচ উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া দরকার।
  3. সামাজিক আন্দোলন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি: তিস্তা নদী রক্ষায় জাতীয় পর্যায়ে আরও আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
  4. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গ্রহণ করা: জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা নিয়ে নদী রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

উপসংহার

‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’ আন্দোলন বাংলাদেশের পানি রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। এটি শুধু বিএনপির একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়, বরং তিস্তা পারের সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন। সরকার ও বিরোধী দল উভয়কেই রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে তিস্তা সংকট সমাধানের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে।


আরও পড়ুন- আন্তর্জাতিক নদী ও আন্তর্জাতিক আইনঃ বাঁধ নির্মাণের নীতিমালা


FAQs

  1. ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’ আন্দোলন কী?
    • এটি বিএনপির উদ্যোগে ২০২৫ সালের ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি পরিচালিত একটি আন্দোলন, যার মূল লক্ষ্য তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও তিস্তা নদীর ন্যায্য পানির হিস্যা নিশ্চিত করা।
  2. তিস্তা নদীর সমস্যা কী?
    • শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকট এবং বর্ষায় অতিরিক্ত পানির প্রবাহ, যা বন্যা ও নদীভাঙনের কারণ হয়।
  3. সরকার তিস্তা সমস্যার সমাধানে কী করছে?
    • সরকার ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজছে এবং তিস্তা মহাপরিকল্পনার আওতায় কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
  4. বিএনপি কেন এই আন্দোলন করছে?
    • বিএনপি এই আন্দোলনকে সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরার একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে, পাশাপাশি তিস্তা পারের মানুষের দাবি জোরালো করছে।
  5. তিস্তা মহাপরিকল্পনা কী?
    • এটি একটি সমন্বিত পরিকল্পনা, যার মাধ্যমে নদীভাঙন প্রতিরোধ, সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ এবং তিস্তা নদীর উন্নয়ন করা হবে।
  6. তিস্তা নদী কিসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?
  7. তিস্তা সমস্যার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কারা?
    • রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
  8. ভারত তিস্তার পানি কেন আটকে রাখছে?
    • তাদের নিজস্ব কৃষি ও শিল্প ব্যবস্থার চাহিদা মেটাতে তিস্তার উজানে বাঁধ নির্মাণ করেছে।
  9. বাংলাদেশ তিস্তার পানি নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে পারে কি?
    • হ্যাঁ, তবে এখনো সরকার কূটনৈতিকভাবে সমাধান করার চেষ্টা করছে।
  10. তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাজেট কত?
  11. প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার।
  12. তিস্তা সমস্যার সমাধানে চীন কী ভূমিকা রাখতে পারে?
  13. চীন বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা মহাপরিকল্পনায় বিনিয়োগ করতে চায়।
  14. তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন হলে কী লাভ হবে?
  15. কৃষি উন্নয়ন, নদীভাঙন রোধ এবং পানি সংরক্ষণের সুবিধা পাওয়া যাবে।
  16. এই আন্দোলন কতদিন চলবে?
  17. এটি পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে।
  18. সরকার কি এই আন্দোলন দমন করতে পারে?
  19. সরকার এখনো কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেয়নি।
  20. বিএনপি কি এই আন্দোলন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে?
  21. অনেকে মনে করেন এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হলেও এটি জনগণের দাবিও বহন করছে।
  22. আন্দোলনে সাধারণ মানুষ কীভাবে অংশ নিতে পারে?
  23. প্রতিবাদ কর্মসূচি, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং অনলাইনে প্রচারণার মাধ্যমে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *